দেশে সাংবাদিকেরা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। আর সাংবাদিকদের প্রচলিত আইন ছাড়াও আরো কমপক্ষে ১৯ ধরনের আইন ও বিধি মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয়।
কিন্তু সাংবাদিককের সুরক্ষার কোনো আইন নাই। তাই সহজেই চুরি, ডাকাতিসহ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আসামি করা যায় সাংবাদিকদের।
সর্বশেষ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ছাড়াও আরো যেসব আইন ও বিধি সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রক হিসেবে আছে, আদালত অবমাননা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, কপিরাইট আইন, প্রেসকাউন্সিল অ্যাক্ট, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, পোস্ট অফিস অ্যাক্ট, শিশু আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, তথ্য অধিকার আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ভোক্তা অধিকার আইন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধান।
এসব আইনের মধ্যে বেশ কিছু আইন আছে ঔপনিবেশিক আমলের। যেমন আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬ সালের আর অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ সালের।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ১০০ বছরের পুরনো অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট আইনে মামলা করা হলেও নিকট অতীতে আর নজির নাই। আর এই আইনটি তথ্য অধিকার আইনের পর মৃত হয়ে গেলেও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে আবার ফিরে আসে।
নতুন করে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশি ব্যবহার হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। তবে ফৌজদারি আইন এবং মানহানি আইনও ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
আর্টিকেল নাইনটিনের হিসাব মতে, গত বছর ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ১৭২টি মামলার মধ্যে ৭০টি মামলা করা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এর বাইরে মানহানিসহ বিভিন্ন আইনে ওই বছর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪১০টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩২ জন সাংবাদিককে । তাদের হিসেবে সাংবাদিকদের হয়রানি ও মামলার জন্য শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক নেতারা দায়ী। আর ৮০ ভাগের মধ্যে ৪০ ভাগ পুলিশ ও র্যাব। গত বছর ২০টি মামলা করেছেন এমপিরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে গত বছর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা করেছেন। খবর প্রকাশের কারণে মামলা হয়েছে ৯০টি। সরকারের কর্মকর্তরা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন ২৬ জন সাংবাদিককে। তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০ জন সাংবাদিক। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা হামলা করেছেন ২৫ জন সাংবাদিকের ওপরে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন একজন সাংবাদিক। সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে ৩৪ জন এবং হামলার শিকার হয়েছেন ২৫ জন।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান বলেন,” সাংবাদিকেরা শক্তিমানদের নির্যাতন ও মামলার শিকার হচ্ছেন। প্রশাসন, পুলিশ ছাড়াও হেফাজতে ইসলাম আছে এই তালিকায়। এমনকি ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যানরাও এই বাইরে নয়। যারা দুর্নীতিবাজ তাদের কোপানলে আছেন সাংবাদিকেরা।”
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী মনজিল মোরসেদ বলেন,” সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে যত আইন আছে সেগুলো মাথায় রাখলে তারা সাংবাদিকতা করতে পারবেন না। তাদের এই আইন ভুলে কাজ করতে হবে। শুধু মাথায় রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থ। দুর্নীতির খবর প্রকাশ জনস্বার্থে প্রকাশ করতে হবে। এখানে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তার কোনো বিষয় নাই।”
তার মতে, এখন সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। আরো যেসব কালা কানুন আছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর আইনে সাংবাদিক সুরক্ষার কিছু বিধান আছে সেগুলো সাংবাদিকদের জানতে হবে। । তিনি বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদলতের নির্দেশনা আছে সাংবাদিক তার সোর্স প্রকাশ করতে বাধ্য নয়।
“সাংবাদিকদের বিশেষ করে যার ঢাকার বাইরে কাজ করেন তাদের নানা ধরনের ফৌজদারি মামলা দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা হয়রানি করে। এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নাই” বলেন তিনি।
সাজ্জাদ আলম খান বলেন,” সুনির্দিষ্টভাবে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন দরকার। আমরা এজন্য বার বার দাবি জানিয়ে আসছি। সাংবাদিকদের জন্য এখন এটা জরুরি হয়ে পড়েছে।”