মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে উক্ত অঞ্চলে অন্যান্য দেশ হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলিদের বিরোধে নিশ্চুপ থাকার অবস্থান নেয়, বিশেষ করে সৌদি আরব।
বিশ্বব্যাপী গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলার অব্যাহত প্রতিবাদ, ভারত ব্যতীত ইসরায়েলি আক্রমণের নিন্দা এবং নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রয়োগ- সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটল ইসরায়েলি যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মাধ্যমে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এক বিবৃতি প্রদান করে ইসরাইলকে আরও আধুনিক অস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে।
প্রায় এগারো দিনব্যাপী চলতে থাকা এক অবিশ্বাস্য যুদ্ধ চলছিল গাজা উপত্যকায়। ১১ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ২৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে ১০০ জন নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি।
ফিলিস্তিনিদের জনবসতির কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনী নেই। তারপরও ঘরে তৈরি রকেট উৎক্ষেপণ করে ইসরাইলকে বাধ্য করেছে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যবহার করতে। যে আয়রন ডোম নামক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ইসরাইল গড়ে তুলেছে, তা কার্যত কতটা সার্থক, তা বোঝা যায়নি। কারণ, এই হাতে তৈরি রকেট লঞ্চার নিয়মিত ইসরাইলের অভ্যন্তরে আঘাত হেনেছে। এবার এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটেছিল রমজানে জেরুজালেমে মসজিদের অভ্যন্তরে পুলিশ প্রবেশকে কেন্দ্র করে। জেরুজালেমে সূচিত সেই প্রতিবাদ গাজা উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং গাজা উপত্যকা থেকে হামাস নামক ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী রকেট আক্রমণ শুরু করেছিল ইসরায়েলের অভ্যন্তরে।
রকেট উৎপাদনের কৌশল তারা ইরানিদের কাছ থেকে রপ্ত করেছে। যদিও ইরান একটি শিয়া ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্র, যাদের সঙ্গে সুন্নিদের এক বিরাট সঙ্কট রয়েছে ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে।
জো বাইডেন মার্কিন পক্ষ থেকে ঘোষণা করেছেন, তিনি আরও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইসরাইলের কাছে হস্তান্তর করবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান- উভয় দলই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইহুদি সম্প্রদায় দ্বারা প্রভাবিত, যারা মূলত পূর্ব ইউরোপ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন গ্রহণ করেছিল।
গত শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে জাতিসংঘ জন্ম নেওয়ার ভেতর থেকে বিশ্বে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে একটি অবস্থান সৃষ্টি হয়। পরিণতিতে পৃথিবীর সবগুলো ভূখণ্ডের ঔপনিবেশিক অবস্থার বিলুপ্ত হয়ে স্বশাসনের ব্যবস্থা স্বীকৃতি লাভ করে। সেই সময় ব্রিটিশ উপনিবেশ সাম্রাজ্য হারায়। এছাড়াও আরও যে সমস্ত দেশের উপনিবেশ ছিল, তারাও বাধ্য হয় তাদের উপনিবেশগুলোতে স্ব-শাসন প্রবর্তন করতে। যদিও ওই ভূখণ্ডগুলোতে শতাব্দীর শুরুতেই কয়েক দশক ধরে স্ব-শাসনের দাবিতে আন্দোলন চলছিল।
ব্রিটিশরা তাদের এই উপনিবেশ হারানোর কিংবা ঔপনিবেশিকতার পরিসমাপ্তি ঘটার সময়ে বিশ্বের ওপর তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য বিশ্বের প্রধান তিনটি ভূখণ্ডে একটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে রেখে যায়। স্ব- শাসনের নামে ক্ষমতা হস্তান্তর করে; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের হাতের মধ্যেই চলে যায়। কারণ তখন জাতিসংঘ গঠিত হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা বিশ্বের সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাঁচ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদের ইচ্ছার বাইরে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পৃথিবীতে গৃহীত হয়নি।
তাদের অন্যতম ব্রিটিশরা যে তিনটি ভূখণ্ডে রাজনৈতিক সংকটের বীজ রোপণ করে, তা হলো, মূলত ফিলিস্তিন সংকট, কাশ্মীর সংকট আর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংকট। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুনির্দিষ্টভাবে এই সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী।
বিশ্বের সবচেয়ে সংকটময় অধ্যায় হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন সংকট। ফিলিস্তিন সংকটকে সামনে রেখেই বিশ্বের তাবৎ সংকটের জন্ম হচ্ছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের ভেতর থেকে ফিলিস্তিন সংকটের শুরু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প আগে ১৯১৭ সালে লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর কনজারভেটিভ দলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক ঘোষণায় ফিলিস্তিনে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বহুকাঙ্ক্ষিত পুণ্যভূমির ঘোষণা দেন। যেটা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। সেই সময় মুসলিম বিশ্বের প্রধান শক্তি ছিল অটোমান সাম্রাজ্য। পৃথিবীতে আজকের মতন অনেকগুলো মুসলিম দেশের জন্ম হয়নি। পৃথিবীতে জাতিসংঘ নেই। এমন পরিস্থিতিতে বেলফোর ঘোষণায় পৃথিবীব্যাপী আগামীতে কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা নিয়ে ভাবার কোনো দেশের তখন জন্ম হয়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তেমন কোনো মুসলিম দেশ গড়ে ওঠেনি। মুসলিম বিশ্ব হিসেবে পরিচিত অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। ফলে মুসলিমদের সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। মধ্যপ্রাচ্যের যে অংশে ইসরায়েলের জন্ম হলো, সেখানে এক বিরাট মুসলিম ধর্মীয় জনগোষ্ঠী অবস্থান করছিল। ইসরায়েলি গোড়াপত্তনের সময় ওই ভূখণ্ডের পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলো ইসরাইলের অস্তিত্ব মেনে নিতে রাজি হয়নি। ফলে সেই গোড়া থেকে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ভূখণ্ডের মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সংকট সৃষ্টি হয়, তার আজ ৭০ বছরেও নিষ্পত্তি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্মের পর দেশটিতে ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। দেশটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো নির্বাচনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এক ভিন্নধর্মী নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা অনুযায়ী, এর নির্বাচকমণ্ডলী কোনো ব্যক্তিকে ভোট প্রদান করেন না। দেশটিতে নিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দলসমূহকে ভোট প্রদান করে এবং এই রাজনৈতিক দলসমূহ আনুপাতিক হারে তাদের আসন লাভ করে।
দেশটির পার্লামেন্টের নাম রাখা হয়েছে নেসেট, ১২০ আসনের পার্লামেন্টে। আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেনি। দেশটিতে বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ও বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী, ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাসী- এমনি নানান ভাবধারার রাজনৈতিক দলের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তবে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রাধান্যই এখানকার বৈশিষ্ট্য।
তাদের সংবিধান অনুসারে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচিত হয় চার বছরের জন্য। কিন্তু প্রথম থেকে আজ অবধি কখনো পার্লামেন্ট সদস্যরা চার বছর সময় পূর্ণ করতে পারেনি। এ পর্যন্ত দেশটিতে ২৪ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশটির বর্তমান পার্লামেন্টে ১৩টি রাজনৈতিক দলের সদস্য প্রতিনিধিত্ব করছেন। এর পাশাপাশি দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম, সশস্ত্র যুদ্ধ ইত্যাদির ভেতর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্বমোড়লরা দুই জাতিতত্ত্ব সামনে নিয়ে আসে। অর্থাৎ দুটি রাষ্ট্র। ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র।
ধীরে ধীরে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ইসরাইলের অস্তিত্ব মেনে নেয়। সুন্নি সম্প্রদায়ের দেশগুলো ইসরাইলের অস্তিত্ব মেনে নিলেও শিয়া অধ্যুষিত পৃথিবীর একমাত্র দেশ ইরান এখনো ইসরাইলের অস্তিত্ব মানেনি। মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট নিরসনে বিশ্ব মোড়লদের নানান আলোচনার ভেতর থেকে ফিলিস্তিনি অথরিটির জন্ম হয়।
পশ্চিম তীরের জনগোষ্ঠীকে শাসনের আওতায় রয়েছে ইয়াসির আরাফাতের প্রতিষ্ঠিত দল ফাত্তাহ পার্টি আর অন্যদিকে গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি অথরিটি গঠিত হওয়ার আগে থেকেই রয়েছে হামাস নামক একটি সুন্নি ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা মূলত ইসরাইলের অস্তিত্ব মানতে রাজি নয়। যদিও ইসরাইল এখন একটি বাস্তবতা। মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রায় ২০ লক্ষ জনসংখ্যার গাজা উপত্যকাটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভূখণ্ড। জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশের উপর। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই মানুষগুলোর অর্থনৈতিক জীবন ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল। এদের অধিকাংশই ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কর্মরত।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলিদের বিরোধে নিশ্চুপ থাকার অবস্থান নেয়, বিশেষ করে সৌদি আরব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ব্রিটিশ উপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেই সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে আজকের এই অশান্ত পরিস্থিতি।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, সেটি ভাববার বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করার ভেতর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা আরও কঠিন করে তুলে গেছেন। মার্কিন মুল্লুকের দেশটিতে মিডিয়া জগত, অর্থনীতি জগতের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ- যাদের প্রধান অংশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিতে ইহুদি নিধন ঘটনার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন। তারাই মার্কিন রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। যদিও ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ৫৫ লক্ষের বেশি হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারপরও এই স্বল্পসংখ্যক ইহুদি সম্প্রদায় গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সুত্রঃ মনোয়ারুল হক (টিবিএসনিউজ)