একজন কন্যা এবং তার বাবার মধ্যকার কথোপকথন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি বিষয়। এটিতে আড়িপাতা বা রেকর্ড করে রাখার কোনো আইনি এখতিয়ার রাষ্ট্রের নেই। সুতরাং কথোপকথনটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা অপরাধ।
শেষ পর্যন্ত যে শঙ্কা ছিল, সেটিই সত্য প্রমাণিত হল। ভুক্তভোগীর মানহানি করার যে জঘন্য সংস্কৃতি এ দেশে বহুদিন ধরেই চলছে, সেটি শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশি প্রশাসনের দুর্নীতির নিয়ে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য আলোচিত সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে।
রোজিনাকে 'প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্রের' একজন ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে, রোজিনার এক সহকর্মী ও তার বাবার মধ্যকার ফোনালাপের একটি ক্লিপ ফাঁস করে তা সামাজিক যোগাযোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফোনালাপটিতে ওই সহকর্মীকে রোজিনা ইসলাম সম্পর্কে এমন কিছু আপত্তিজনক শব্দ ব্যবহার করে শোনা গেছে যা জনসমক্ষে ব্যবহৃত হলে সেটিকে মানহানি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। রোজিনার বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত বা পেশাগত বিদ্বেষ থাকতে পারে। বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় সেই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেছিলেন তিনি। [শব্দগুলি মানহানিকর হওয়ায়, আমরা এখানে সেগুলো প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছি।]
একজন কন্যা এবং তার বাবার মধ্যকার কথোপকথন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি বিষয়। এটিতে আড়িপাতা বা রেকর্ড করে রাখার কোনো আইনি এখতিয়ার রাষ্ট্রের নেই। সুতরাং কথোপকথনটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা অপরাধ।
কথোপকথনটিকে জনসম্মুখে কে প্রকাশ করেছে?
টেলিফোনের কথোপকথন পর্যবেক্ষণ এবং রেকর্ড করার সরঞ্জাম রয়েছে সরকারি সংস্থার কাছে। এটি করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, হয় অপরাধীদের সনাক্ত করা এবং তাদের গ্রেপ্তার করা অথবা পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে যেকোনো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের প্রচেষ্টা বানচাল করে দেওয়া।
এই সিস্টেমটি তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তি কেনার জন্য এ দেশের করদাতাদের দেওয়া অর্থের একটি বিশাল পরিমাণ ব্যয় করা হয়েছে। আবার নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সিস্টেমটি সচল রাখতে প্রতিদিনই করদাতাদের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, কোনও প্রয়োজন ছাড়াই নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই সিস্টেমটির অপব্যবহার করা হয়েছে।
কোনও সাধারণ নাগরিক অন্য ব্যক্তিদের টেলিফোন কথোপকথনে আড়ি পাততে বা রেকর্ড করতে পারেন না। সুতরাং এটি ধারণা করা যায় যে, পিতা-কন্যার মধ্যকার এই কথোপকথনে আড়ি পাতা, তা রেকর্ড করা এবং ফাঁস করার কাজটি কর্তৃপক্ষের কেউই করেছেন।
এই কাজটি করার মাধ্যমে, কথোপকথন ফাঁসকারী কর্তৃপক্ষগুলো স্পষ্টতই দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের লঙ্ঘন করেছেন। সংবিধানের ৪৩(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, "রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতারক্ষার অধিকার থাকিবে।" সে হিসেবে রোজিনা ইসলামের ওই সহকর্মী এবং তার পিতার মধ্যকার কথোপকথনের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা এই রাষ্ট্রের সংবিধান তাদের দেয়।
একইসঙ্গে সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ দেশের নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতার যে মৌলিক অধিকার দিয়েছে তার উপর এটি একটি নগ্ন আক্রমণ। যারা এই ফোনালাপ ফাঁস করেছেন তারা সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদও লঙ্ঘন করেছেন।
শুধু তাই নয়, যারা এই ফোনালাপ ফাঁস করেছেন তারা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বেরও অবহেলা করেছেন। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, "সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।"
তাহলে একজন পিতা এবং তার কন্যার মধ্যকার ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করে দিয়ে এই 'কর্তৃপক্ষরা' কীভাবে তাদের সেবা করলেন?
কথোপকথন ফাঁসকারী কর্তৃপক্ষের হয়ে যারা কাজ করেন তারাও এই বাংলাদেশের নাগরিক। আর এ দেশের নাগরিক হওয়ায় সংবিধানের বিধান মানতে তারা বাধ্য।
তারা কি সংবিধান মানছে?
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু তথাকথিত 'গোপন নথি'র ছবি তুলেছেন।
এ ঘটনায় তাকে দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা অবরুদ্ধ রাখার সময় মন্ত্রণালয়টির কর্মকর্তারা তার সঙ্গে যেভাবে আচরণ করেছেন তা আইনের শাসনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, তিনি নিচে পড়ে আছেন। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন জোর করে কেড়ে নেওয়া হয় এবং ওই ফোনের পাসওয়ার্ড দিতে তাকে বাধ্য করা হয়। সুতরাং সচিবালয়ের ওই কক্ষে সাংবাদিক রোজিনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও লঙ্ঘিত হয়েছে। তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। তার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে সেটি ছিল নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং অবজ্ঞাপূর্ণ। এই ধরনের আচরণ সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ এবং ২০১৩ সালে প্রণয়ন করা নির্যাতন বিরোধী আইনের অধীনে এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ।
আরও একধাপ এগিয়ে রোজিনা ইসলামকে নিয়ে কুৎসা রটাতে জনগণের করের টাকা ব্যয় করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত এখনো চলমান হলেও ওই বিজ্ঞাপনে স্বনামধন্য এই অনুসন্ধানী সাংবাদিককে 'চোর' হিসেবে চিহ্নিত করেছে মন্ত্রণালয়। যে সংবাদমাধ্যমগুলো এই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করেছে তাদের বিরুদ্ধেও সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
তবে হতাশার কথা হলো- এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং এর কর্মকর্তারা এই দেশের সংবিধান, নির্যাতন বিরোধী আইন এবং সামগ্রিকভাবে আইনের শাসন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি।
টেলিফোনে কথোপকথন ফাঁসকারী এবং রোজিনার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা লোকজনের কি এই এই দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে কোনো জানাশোনা নেই? এ ঘটনায় তারা কী কোন অপরাধ করেনি? সামাজিক মাধ্যমে এই ফোনালাপ শেয়ার করা লোকজন কি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন করছে না?
এরা কি আইনের উর্ধ্বে? তারা কি আইনের দৃষ্টিতে সমান নয়?
এই টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস হওয়া প্রকাশ করে, ক্ষমতায় থাকা লোকজন আইনের বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না।
অতীতেও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের এবং সরকারের কাছে ঝামেলাপূর্ণ লোকজনের ফোনালাপ প্রায়শই ফাঁস হতো। এ কাজটি করা হতো, হয় তাদের মানহানি করার জন্য নতুবা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গ্রাউন্ড তৈরি করার জন্য।
কিন্তু এভাবে যারা দেশের আইন লঙ্ঘন করেছে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রোজিনাকে গ্রেপ্তারের পর আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে প্রশাসনের রন্ধে রন্ধে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতির খবর উন্মোচন করে যে সুনাম তিনি কুড়িয়েছেন, সেটি খর্ব করতে কোনো না কোনোভাবে তার মানহানির অপচেষ্টা শুরু হবে। দিনশেষে তাই হলো। মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস এই অপচেষ্টারই একটি অংশ। খারাপ খবর যে আনে তাকে শাস্তি দেওয়ার সেই প্রাচীন কৌশল এটি। একইসঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতার গলা চেপে ধরার পুরনো পদ্ধতিও এটি।
সুত্রঃ শাখাওয়াত লিটন, উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার বেআইনি ।
2023 DailyNews24BD.com