কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন ইন্টারনেটে কাউকে তীব্র ও ক্ষতিকর ভাষায় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানায়, তাকে অনলাইন হয়রানি বলে। নারী সাংবাদিকরা এমন হামলার শিকার হন বেশি। ইউনেস্কো ও আইসিএফজে বলেছে, অনলাইন হয়রানি “নারী সাংবাদিকদের জন্য নতুন যুদ্ধক্ষেত্র।” তাদের জরিপ অনুযায়ী, ৭৩ শতাংশ নারীই কোনো না কোন ধরনের অনলাইন সহিংসতার মুখে পড়েছেন। বাংলাদেশেও নারী সাংবাদিক গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে অনলাইনে অপপ্রচার দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতিতে সাংবাদিকরা কী করবেন এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব কী – এসব নিয়েই এই প্রতিবেদন।
১৫ বছরের রিপোর্টিং ক্যারিয়ারে, লেখালেখির কারণে ইমেইল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক গালমন্দ ভরা মেসেজ পেয়েছেন এরিক লিটকে।
তিনি ভাবতেন “এটি এই পেশারই অংশ”।
কিন্তু ইউএসএ টুডে ও পোলিটিফ্যাক্ট উইসকনসিনে তথ্য যাচাইয়ের কাজ করতে গিয়ে, মানুষের মনোভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন নজরে আসে লিটকের। তিনি বরাবরই নিজের গর্ব করার মতো প্রতিবেদনগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন। কিন্তু গত তিন বছর ধরে দেখছেন, তাকে পাঠানো বিদ্বেষপূর্ণ বার্তাগুলো ক্রমেই ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে, এবং বেশিরভাগই আসছে নিজ বলয়ের মানুষদের কাছ থেকে।
ভুয়া কন্টেন্ট মডারেশনের কাজে ফেসবুককে সহায়তা করছে লিটকের তথ্য যাচাই। এখানে তিনি বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তবে এই কাজের জন্য যেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন, তার অনেকটাই অযৌক্তিক ও আবেগতাড়িত। সম্প্রতি ফেসবুকে এক পুরনো বন্ধু তাকে বলেছেন, তার “আগের কাজকর্ম আরো অর্থবহ ছিল।”
লিটকে বলেছেন, “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও তথ্য যাচাই; দুই ধরনের কাজে প্রতিক্রিয়ার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা হয়।” তার মতে, এখনকার মানুষের প্রবৃত্তি হলো যুক্তি ও তথ্যের পেছনের জটিল চিন্তাটাকে বোঝার চেষ্টা না করেই, একটা প্রতিক্রিয়া দিয়ে ফেলা। তারা শুধু তাকিয়ে থাকেন কখন বলবেন, ‘আচ্ছা, আপনি এই লোকটাকে এইভাবে মূল্যায়ন করেছেন, তার মানে আপনি পৃথিবীর কলঙ্ক, অথবা তার মানে, কি মেধাবী আপনি, আপনার কাজ তো প্রশংসা করার মতো।’ মন্তব্যটা হয় শুধু মাত্র তাদের তাৎক্ষণিক ভাবনার ভিত্তিতে।”
আরো খারাপ উদাহরণও আছে। একবার ইমেইলে অচেনা এক লোক তাকে এমন হুমকি দেন, যা তিনি ও তার সম্পাদক পুলিশকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
“এমন ঘটনা আমার ক্যারিয়ারে আগে ঘটেনি,” বলেন লিটকে। “পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, তার ইঙ্গিত হল, মানুষ এখন এত বাজে ভাষায় ইমেইল পাঠায় যে আপনি ভাববেন ‘হয়তো সে সত্যি সত্যি বাড়িতে এসে হাজির হবে না, কিন্তু বিষয়টা এখনই আরো কয়েকজনকে জানিয়ে রাখা উচিৎ।’”
পরিবেশ এখন বেশ প্রতিকূল। শারীরিক হামলার হুমকি, ডক্সিং, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রাইভেসি লঙ্ঘন, এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া ছবির বিদ্বেষপূর্ণ বিকৃতি – এখন এসব বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবতে হচ্ছে রিপোর্টারদের, যা আগে অনেক দূরের ব্যাপার বলে মনে হতো। এধরনের হামলার কারণে রিপোর্টাররা সত্যিকারের জীবন-মরণ সঙ্কটে পড়ে যেতে পারেন। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হতে পারে, এবং এমনকি তারা পেশা ছাড়তেও বাধ্য হতে পারেন।
অনলাইন জগতে এখন সত্যের বস্তুনিষ্ঠতা হামলার সম্মুখীন, একইভাবে সাংবাদিকরাও। তাই রিপোর্টারদের এখন নিজেদের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবা জরুরি।
অপপ্রচার ও অনলাইন হয়রানির মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়
কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন কাউকে তীব্র, ব্যাপক ও ক্ষতিকর ভাষায় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানায়, তাকে অনলাইন হয়রানি বলা হয়। এটি একটি সার্বিক পরিভাষা, যার মধ্যে আছে: ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য, যৌন হয়রানি, হ্যাকিং ও ডক্সিং, যার অর্থ কারো ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া।
নারী সাংবাদিকরা এই ধরনের হামলার শিকার হন অনেক বেশি। ইউনেস্কো ও ইন্টারন্যাশন্যাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইন হয়রানি “নারী সাংবাদিকদের জন্য নতুন যুদ্ধক্ষেত্র।” বিশ্বজুড়ে ৭০০-র বেশি নারী সাংবাদিকের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ নারীই কোনো না কোনো ধরনের অনলাইন সহিংসতার মুখে পড়েছেন।
তারা যৌন নির্যাতন, শারীরিক সহিংসতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা সংক্রান্ত হামলার হুমকি পেয়েছেন। হয়রানিমূলক ও অযাচিত বার্তা পেয়েছেন। তাদের ছবি বিকৃত করে যৌন ইঙ্গিত দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যক্তি-মর্যাদা ও পেশাগত বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করতে চাওয়া হয়েছে। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া নারী সাংবাদিকদের পাঁচভাগের দুইভাগই বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালানো হয়েছে পরিকল্পিত ভুয়া তথ্য প্রচারণার অংশ হিসেবে।
অনলাইন হয়রানি প্রায়ই “অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত” থাকে কোনো ভুয়া তথ্যের প্রচার-প্রচারণার সঙ্গে। এভাবে সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা, বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করা হয়। পেন আমেরিকার নোরা বেনাভিদেজ বলেছেন, একই ঘটনা ঘটতে পারে ব্যক্তি রিপোর্টারদের সঙ্গেও। পেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সাংবাদিক ও নিউজরুমগুলোকে অনলাইন হয়রানির বিরুদ্ধে সুরক্ষা গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দেয়।
“অনলাইনে জন্ম নেওয়া একেকটি ইস্যুকে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে কৌশলের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে: সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া। সাধারণভাবে উঠে আসা একটি ভাষ্যের প্রতি সংশয় তৈরি করা,” বলেছেন নোরা।
উভয় ক্ষেত্রেই, এই হামলাগুলো হয় খুব সমন্বিতভাবে, যদিও দেখে মনে হতে পারে, যিনি হামলার শিকার তাকে এমনিই লক্ষ্যহীনভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। (এ ধরনের ঘটনা নিয়ে ইন-ডেপথ অনুসন্ধানের একটি সংকলন, দ্য মিডিয়া ম্যানিপুলেশন কেসবুক। যেখানে দেখা যায় অনলাইন হয়রানি ও ভুয়া তথ্যের প্রচারণার মধ্যে খুবই উঁচু পর্যায়ের সমন্বয় আছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ভুয়া তথ্যের প্রচারণার কথাও উঠে এসেছে, যেগুলো অনলাইনে কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটিগুলোর মধ্যে ছড়ানো হয়েছিল মহামারির শুরুর সময়টিতে।)
“অনলাইন হয়রানি ও ভুয়া তথ্যের প্রচারণাকে আমি মনে করি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, বা একই বর্শার দুইটি ফলা,” বলেছেন পেন আমেরিকার ডিজিটাল নিরাপত্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশ প্রকল্পের পরিচালক ভিক্টোরিয়া ভিল্ক। তাঁর ভাষায়, “দুই ক্ষেত্রেই লক্ষ্য থাকে ভুয়া ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে একটি বড় পরিসরকে দূষিত করা। কিন্তু যে প্রকৃত সত্য তথ্যগুলোকে তারা ভুল প্রমাণের চেষ্টা করছে, সেগুলো এসেছে অনেক মর্যাদাপূর্ণ সোর্স থেকে। ফলে, সেগুলোকে ভুয়া প্রমাণ করার জন্য আপনাকে আগে প্রমাণ করতে হবে, সেই সোর্সের পেশাজীবীরা বিশ্বাসযোগ্য নন। এজন্য, যে তথ্যকে আপনি চাপা দিতে চান বা দূষিত করতে চান, সেই প্রকৃত তথ্যের পেছনে থাকা রিপোর্টারের সম্মানহানি করতে হবে, ভয় দেখাতে হবে বা চুপ করিয়ে দিতে হবে।”
তবে এমনও নয় যে, দুটি বিষয় সব সময়ই হাতে হাত ধরে চলে। সব অনলাইন হয়রানিই হয়তো প্রচারণার অংশ হিসেবে হয় না। কখনো কখনো এটি সত্যিই খুব বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকে। মাঝেমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরাও কারো ওপরে চড়াও হয়, যিনি তাদের মধ্যে ক্ষোভ বা বিরক্তি তৈরি করেছেন।
এতো মিল থাকার পরও, ভুয়া তথ্য ও অনলাইন হয়রানির বিষয়কে একইভাবে দেখার বা বোঝার চেষ্টা করা হয়নি। ভুয়া তথ্য নিয়ে গবেষণার বেশিরভাগটা জুড়ে আছে: কুপ্রভাব তৈরির নেটওয়ার্ক, সোশ্যাল মিডিয়া বট, ভুয়া সংবাদ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি উন্মোচন। কিন্তু অনলাইন হয়রানির বিষয়টি এরকম বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়নি, বলেছেন বেনাভিদেজ ও ভিল্ক। গবেষক ও রিপোর্টাররা বেশিরভাগ সময়ই মনোযোগ দিয়েছেন হয়রানির শিকার হওয়া ব্যক্তি থেকে পাওয়া তথ্যের দিকে। কিন্তু এসব হামলার পেছনে কী ধরনের কৌশল-পদ্ধতি কাজ করছে, সেগুলো তারা তলিয়ে দেখেন নি।
ভিল্ক বলেছেন, “এই ধরনের অনলাইন হয়রানির ঘটনা যখন ঘটে, তখন সেসব নিয়ে ভালো কোনো ফরেনসিক অনুসন্ধান হয় না। যে কারণে আমাদের কাছে অনেক তথ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু এসবের পেছনে, ইন্টারনেটের অন্ধকার কোনায় হয়তো অনেক উঁচুদরের সমন্বিত কর্মকাণ্ডের খোঁজ পাওয়া যাবে। তবে আমাদের কাছে এমন পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই যে, আমরা বলতে পারব: এই [অনলাইন হয়রানির] ঘটনাগুলো কতটা গভীর সমন্বয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে।”
লক্ষ্যবস্তু হওয়ার আগে অনলাইন উপস্থিতি সংহত করুন
স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরা, ডক্সিং-কে অনেক দূরের বিষয় বলে মনে করেন। তারা ভাবেন, এসব বুঝি শুধু জাতীয় পর্যায়ের বা বিদেশী রিপোর্টারদের সাথেই হয়।
লিটকে বলেছেন, “বেশিরভাগ মানুষের বিবেচনায় এটি হয়রানির একটি নতুন সংস্করণ মাত্র। চেনা-জানা কেউ এর শিকার না হওয়া পর্যন্ত, বিষয়টি বাস্তব বলে মনে হয় না।”
কিন্তু জনপরিসরের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভুয়া তথ্যের বিস্তার বাড়ার সাথে সাথে, রিপোর্টারদের অনলাইন হয়রানির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। পেন আমেরিকার অনলাইন হ্যারাসমেন্ট ফিল্ড ম্যানুয়ালে বলা হয়েছে, এধরনের হয়রানির শিকার হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেয়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া ভালো।
দক্ষিণ ফ্লোরিডার সেমিনোল ট্রিবিউনের সাংবাদিক ড্যামন স্কট বলেছেন, ভুয়া তথ্য নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা, অন্য যে কোনো বিটের চেয়ে অনেক আলাদা। ২০২০ সালে, তথ্য যাচাইয়ের বৈশ্বিক সংগঠন, ফার্স্ট ড্রাফটের ফেলো হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে ভুয়া তথ্য পর্যবেক্ষণের কাজ করেছিলেন স্কট। এর আগে তিনি কখনোই ভুয়া তথ্যের বিস্তার সংক্রান্ত বিষয়গুলো এতো গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখেননি। “প্রতিদিন কী ধরনের ব্যাপার নিয়ে কাজ করতে হবে, সে সম্পর্কে খুব বেশি কিছু না জেনেই আমি কাজ শুরু করেছিলাম,” বলেছেন স্কট।
তাঁর ভাষায়, “এই ফেলোশিপের জন্য আমি যেভাবে বসে বসে ভুয়া তথ্য বিশ্লেষণ করেছি, তা আগে কখনো করা হয়নি। এটি আমার মনমেজাজ ও চেতনাকে কিভাবে প্রভাবিত করবে, সে ব্যাপারেও আমি প্রস্তুত ছিলাম না। যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও বেশি পীড়াদায়ক ছিল পুরো অভিজ্ঞতাটি। আমাকে যদি কাজটি আবার শুরু থেকে করতে বলা হয়, তাহলে হয়তো আমি তা করব। কিন্তু এটি আমার জন্য চোখ খুলে দেওয়ার মতো ব্যাপার ছিল।”
এই কাজের পর তিনি নিজের সোশ্যাল মিডিয়া উপস্থিতিতে আরো কড়াকড়ি আরোপ করেন। ফেসবুক থেকে প্রায় সবাইকে আনফ্রেন্ড করে দেন। ইউজারনেম বদলে ফেলেন এবং অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করতে শুরু করেন শুধু পেশাগত কাজের জন্য।
“ফেসবুকের এসব গ্রুপে কেউই হয়তো জানে না যে, আমি আগে কে ছিলাম। কিন্তু কেউ যদি চেষ্টা করে, তাহলে হয়তো আমার পরিচয় সনাক্ত করে ফেলতে পারবে,” বলেছেন স্কট।
এসব হয়রানি এড়ানোর আরেকটি কার্যকরী উপায় হতে পারে সাপোর্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। যে রিপোর্টাররা ভালো ব্যাখ্যামূলক কাজ করেন এবং অনলাইন কমিউনিটিতে বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হয়ে উঠেছেন, তারা হ্যাকার বা ট্রোলদের হামলায় কম ক্ষতিগ্রস্থ হন।
“আপনার যখন কাজের জন্য সুনাম তৈরি হবে, তখন আপনি সবাইকে বলতে পারবেন, আপনার সঙ্গে কী ঘটছে। এবং তারা আপনার সহায়তায় এগিয়ে আসবে। বিশেষভাবে, আপনি যদি বলতে পারেন, আপনার কী ধরনের সহায়তা লাগবে,” বলেছেন ভিল্ক।
যেমন, কেউ তার নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় আরেকটি অ্যাকাউন্ট খোলার প্রমাণ পান, তাহলে অন্যদের বলতে পারেন সেই অ্যাকাউন্টটি রিপোর্ট করার জন্য। তাহলে সেই সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি হয়তো দ্রুতই সেই নকল অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেবে।
ভিল্ক বলেছেন, “এরকম ক্ষেত্রে, হয়রানির ব্যাপারে দ্রুত সবাইকে জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি বলতে পারেন, ‘এই অ্যাকাউন্টটি আমার না। দয়া করে এটিকে রিপোর্ট করতে সাহায্য করুন। আমার নামে নকল অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকে আসা কোনো তথ্য বিশ্বাস করবেন না।’”
রিপোর্টাররা কিভাবে সংবাদ সংগ্রহ করেন সে সংক্রান্ত বিষয়গুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে সাংবাদিকরা তাদের নেটওয়ার্কে আস্থা-বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন, বলেছেন বেনাভিদেজ।
তিনি বলেছেন, “বিষয়টি শুনতে একটু হোমওয়ার্কের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, এ ধরনের ছোটখাট কিছু ব্যাখ্যা পাঠকদের মধ্যে সাড়া জাগাবে। এবং আপনি বা আপনার নিউজরুম যখন ভুয়া তথ্য প্রচারণার শিকার হবেন, তখন এগুলোই আপনার সুরক্ষা তৈরিতে কাজে লাগবে।”
আরেকটি কার্যকরী উপায় হলো: আগে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ও অনলাইন কর্মকাণ্ডের জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা, বলেছেন ভিল্ক।
তাঁর ভাষায়, “রিপোর্টারদের ভালো দিক হলো, তারা নানান বিষয় অনুসন্ধান করে দেখার জন্য প্রশিক্ষিত হন, যদিও সেগুলো তারা কখনো নিজেদের ওপর প্রয়োগ করেন না। কিন্তু অনলাইনে নিরাপদ থাকার জন্য সেই কাজটিই করতে হবে। তাদেরকে আসলে একজন ডক্সারের মতো করে চিন্তা করতে হবে। এবং অনলাইনে কোথায় কোথায় তাদের পদচিহ্ন আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে: অনলাইনে তাদের সম্পর্কে কী কী তথ্য ছড়িয়ে আছে।”
১. নিজেকে গুগল করুন: কিছুটা “হাস্যকর” মনে হতে পারে, কিন্তু বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে নিজের নাম, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের আইডি, ফোন নম্বর ও বাড়ির ঠিকানা লিখে সার্চ করুন। শুরুটা গুগল দিয়ে করলেও, সেখানে থেমে থাকবেন না। গুগল প্রতিটি ব্যক্তির জন্য আলাদা আলাদা সার্চ ফলাফল নিয়ে আসে। ফলে অন্য কেউ একইভাবে সার্চ করলে হয়তো আলাদা ফলাফল দেখবে। ফলে ডাকডাকগো-এর মতো অন্য সার্চ ইঞ্জিনও ব্যবহার করুন। যেটি ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসিকে প্রাধান্য দেয় এবং ব্যক্তি-কেন্দ্রিক ফলাফল হাজির করে না। আপনার অনলাইন ফুটপ্রিন্টের আরো পূর্ণাঙ্গ অবস্থা জানতে, ব্যক্তিগত তথ্যগুলো দিয়ে সার্চ করুন চীনা সার্চ ইঞ্জিন বাইডুতে।
২. অ্যালার্ট তৈরি করুন: অনলাইনে কে কোথায় আপনার নাম উল্লেখ করেছে, তা সার্বক্ষণিকভাবে নজরে রাখার কথা আপনি আশাও করতে পারেন না। এবং এটি করারও দরকার নেই। আপনার নাম, বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের আইডি, ফোন নম্বর ও বাড়ির ঠিকানা দিয়ে তৈরি করুন গুগল অ্যালার্ট। এতে আপনি জানতে পারবেন অনলাইনে আপনাকে নিয়ে কোনো তথ্য ছড়াতে শুরু করেছে কিনা। আপনি এটি করতে পারেন আপনার বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের মানুষদের জন্যও,” বলেছেন ভিল্ক।
৩. আপনার অনলাইন উপস্থিতি খতিয়ে দেখুন: কেউ যেন আপনার বা আপনার প্রিয়জনদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিতে না পারে, সেজন্য সবচে কার্যকরী পদক্ষেপ হলো: সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা। ভিল্কের পরামর্শ: কোন কাজের জন্য কোন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছেন, সে ব্যাপার কৌশলী হন। আপনি যদি রিপোর্টার হিসেবে কোনো টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রতিবেদন শেয়ার করেন, সহকর্মী ও আপনার পাঠক-দর্শকের সাথে যোগাযোগ করেন, তাহলে এই অ্যাকাউন্টটি কঠোরভাবে পেশাগত কাজেই ব্যবহার করুন। এখানে কোনো বিড়ালের ছবি বা আত্মীয়দের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার ছবি দেবেন না। ভুলে যাওয়া কোনো বিব্রতকর টুইট বা ছবি এই অ্যাকাউন্টে থেকে গেছে কিনা, তা তলিয়ে দেখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বাড়ির ঠিকানা, জন্মদিন, সেল ফোন নম্বর বা এমন কিছু, যা দিয়ে আপনাকে খুঁজে বের করা সম্ভব- এজাতীয় কোনো তথ্য এই অ্যাকাউন্টে শেয়ার করবেন না। “যদি আপনার কুকুর বা সন্তানের ছবি পোস্ট করার জন্য ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করেন, তাহলে আপনার উচিৎ অ্যাকাউন্টটি প্রাইভেট করে রাখা। এবার আপনি এখানে যা খুশি তাই পোস্ট করতে পারেন। কিন্তু এটি অবশ্যই অন্যান্য পাবলিক অ্যাকাউন্ট থেকে আলাদা করে রাখতে হবে,” বলেছেন ভিল্ক।
৪. পুরোনো সিভি ও বায়োর খোঁজ করুন: ইন্টারনেটের সেই যুগ খুব বেশি আগের না যখন সাংবাদিক ও একাডেমিক গবেষকরা তাদের জীবন বৃত্তান্ত বা ব্যক্তিগত তথ্য ওয়েবসাইটে তুলে রাখতেন। এ ধরনের ভুলে যাওয়া কোনো ডকুমেন্ট অনলাইনে থেকে গেছে কিনা খোঁজ করুন। কারণ এগুলো কোনো ডক্সারের জন্য হয়ে উঠতে পারে তথ্যের খনি।
৫. ডেটা ব্রোকারের কথা ভুলবেন না: সহজে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন সোর্সের খোঁজ পেতে সাংবাদিক হিসেবে আপনিও হয়তো স্পোকিও বা হোয়াইটপেজের মতো ডেটা ব্রোকার ওয়েবসাইটে ঢুঁ দিয়েছেন। এ ধরনের ওয়েবসাইটগুলো ইন্টারনেটে খোঁজ চালিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে এবং সেগুলো বিক্রি করে। এর মাধ্যমে ডক্সাররা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সহজেই অনেক তথ্য পেয়ে যায়। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে, হোয়াইটপেজেস ডট কমের মাধ্যমে যে কোনো ইউজার নিজের ব্যক্তিগত তথ্য মুছে ফেলতে পারেন। ওয়েবসাইটের হেল্প পেজ থেকে কিছু নির্দেশনা অনুসরণ করে নিজে নিজেই কাজটি করা যায়। যেসব ওয়েবসাইটে এরকম সুবিধা নেই, তাদের কাছে ইমেইল পাঠিয়ে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য মুছে দেওয়ার দাবি জানাতে পারেন। যদি এতে খুব বেশি সময় লাগে, তাহলে ডিলিটমি বা প্রাইভেসিডাকের মতো সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস ব্যবহারের কথা বিবেচনা করতে পারেন। তবে কোনো রিপোর্টারের জন্য ব্যক্তিগতভাবে এই খরচ বহন করাটা ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে।
৬. শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহারের চর্চা করুন: শুধু রিপোর্টার নয়, এই পরামর্শটি সবার জন্যই প্রযোজ্য। আপনি যদি আপনার জন্মতারিখ সম্বলিত ছয় সংখ্যার পাসওয়ার্ড সব অনলাইন অ্যাকাউন্টের জন্যই ব্যবহার করেন, তাহলে আপনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাকারদের হাতে তুলে দেওয়া বা আপনার নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরির মতো ঝুঁকি নিচ্ছেন। পাসওয়ার্ড যতো বড় হবে, সুরক্ষা তত বাড়বে। টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন আরো ভালো। এবং প্রতিটি অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহারই বুদ্ধিমানের কাজ।
বার্তাকক্ষ যেভাবে কর্মীদের সাহায্য করতে পারে
রিপোর্টাররা তাদের অনলাইন উপস্থিতির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারেন। তবে ভুয়া তথ্য ও অনলাইন হয়রানির দ্বিমুখী দানবকে, একা একা মোকাবিলা করতে যাওয়া ঠিক হবে না। যদিও অনেক সংবাদ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের “অনলাইন সহিংসতার শিকার হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নিতে চায় না,” এমনটাই জানা যাচ্ছে ইউনেস্কোর প্রতিবেদন থেকে। (অনলাইন হয়রানি নিয়ে আপনার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কিভাবে কথা বলবেন, তা নিয়ে দেখুন পেন আমেরিকার গাইড)
ভিল্ক বলেছেন, “আমাদের সবারই কিছু না কিছু করণীয় আছে। রিপোর্টারদের ব্যক্তিগতভাবেও কিছু করণীয় আছে। নিউজরুমগুলোর আরো বেশি পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের উচিৎ রিপোর্টারদের আরো ভালো টুল ও ফিচার দিয়ে সুরক্ষা দেওয়া। এটি খুবই বড়সড় একটি সমস্যা। এবং এটি মোকাবিলার জন্য সবাই মিলে সমাধান বের করতে হবে।”
যে কর্মীরা ভুয়া তথ্য বা অপমানসূচক ক্যাম্পেইনের শিকার হচ্ছেন, তাদের রক্ষা করার জন্য নীতিমালা ও প্রোটোকল তৈরি করতে পারে নিউজরুমগুলো।
“এতে এমন বার্তা দেওয়া যাবে যে, ভুয়া তথ্যের প্রচারণার বিষয়টি বাস্তব এবং নিউজরুম বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে নিচ্ছে। এটি এমন এক ধরনের সংস্কৃতি তৈরি করবে যেখানে রিপোর্টাররা স্বাচ্ছন্দ্যে সামনে এসে এজাতীয় সমস্যাগুলোর কথা প্রতিষ্ঠানকে বলতে পারবে,” বলেছেন ভিল্ক।
সব সময় সফল না হলেও, ভিল্ক বেশ কিছু নিউজরুমকে অনুপ্রাণিত করেছেন অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য, যেন রিপোর্টাররা গুরুতর হুমকির কথা জানাতে পারেন। এরপর সংবাদমাধ্যম সেটি জানাতে পারে প্রযুক্তি কোম্পানি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা কোনো বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিকে। এ ধরনের বৈরি পরিস্থিতির মুখে রিপোর্টার কী করবেন, সে ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ভিল্ক বলেছেন, “কখনো কখনো, এমন হামলার সময়টি এতো অস্থির, ভীতিকর ও চাপের হয়ে যায় যে, বোধশক্তি হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়। কিন্তু আপনার কাছে যদি একটি প্রটোকল থাকে, তাহলে আপনি ভাবতে পারেন, ‘আচ্ছা, এখন তাহলে আমি এমন পদক্ষেপ নিতে পারি। আমি জানি এমন কিছু ঘটলে নিউজরুমে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’”
নিউজরুমগুলো তাদের রিপোর্টারদের সহায়তা করতে পারে অনলাইনে বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য মুছে ফেলার সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস কিনে দেওয়ার মাধ্যমে। এবং দিতে পারে মানসিক ও আইনি সহায়তা। শেষপর্যন্ত, কোনো রিপোর্টার যদি তাঁর নিজ বাড়িতে নিজেকে অনিরাপদ মনে করেন (কারণ ডক্সিংয়ের মাধ্যমে হয়তো তার বাড়ির ঠিকানা সর্বত্র প্রকাশ হয়ে গেছে), তাহলে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তাকে কোনো সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাওয়া।
ভিল্ক বলেছেন, “সত্যি বলতে, এসবের অনেক কিছুই এখন হচ্ছে না। কিন্তু এগুলো অবশ্যই হওয়া উচিৎ।”
অর্থ সংকটে থাকা অনেক নিউজরুমের জন্যই এভাবে একহাতে সমর্থন দেওয়া সম্ভব হয় না। ভুয়া তথ্য ও অনলাইনে হয়রানিমূলক প্রচারণা ক্রমেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। কিন্তু এখনই অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সম্পদের স্বল্পতায় ভুগছে অনেক সংবাদমাধ্যম।
তবে মহামারির সময়ে যেভাবে সংবাদমাধ্যমগুলো একে অপরের সঙ্গে জোট বেঁধে অনেক উঁচু মানের রিপোর্টিং করেছে, তা থেকে আশা খুঁজছেন ভিল্ক। তাঁর মতে, একই রকম জোট গড়ে তোলা যায় ডক্সিং ও হয়রানি থেকে রিপোর্টারদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যও। যেমন, কয়েকটি নিউজরুম মিলে একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে পারে বা অভ্যন্তরীণ রিপোর্টিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।
“আমার মনে হয়, এটিই ভবিষ্যৎ,” বলেছেন ভিল্ক, “এমনটিই হতে হবে। কারণ আমার মনে হয় না অপপ্রচার ও হয়রানি খুব দ্রুত বিদায় নেবে।”
সুত্রঃ হাওয়ার্ড হার্ডলি । উইসকনসিন-ম্যাডিসন ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর জার্নালিজম এথিকস-এর ওয়েবসাইট অবলম্বনে (Global Investigative Journalism Network)