বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছো ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে উচ্চাভিলাষী কিছু সেনা অফিসার ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের কালরাতে সপরিবারে হত্যা করে। যে জাতীয়তাবাদী নেতা দেশের মানুষের কল্যাণচিন্তায় নিজের জীবনের প্রায় তিন ভাগের একভাগ কাটিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যে নেতা নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে। যিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার আলো এনে দিতে উৎসর্গ করেছেন নিজের জীবনকে, জীবনের যত ত্যাগ-তিতিক্ষা সহ্য করেছেন মানুষের মঙ্গলচিন্তায়, সেই নেতা আপামর জনসাধারণের প্রিয় মানুষটিকে স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতির জীবনে এক কলঙ্কতিলক এঁকে দিল। এই দিনে ইতিহাসের কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটিয়ে বাংলার মানুষকে পুরো বিশ্বের কাছে ‘বিশ্বাসঘাতক’ জাতি হিসেবে পরিচিত করল কিছু মানুষরূপী জানোয়ার। পাকিস্তান কখনো যা করতে সাহস করেনি, স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে সেটিই করে দেখিয়েছে এ দেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের এজেন্ট। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিণী আরজু মনি, কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়স্বজন।
এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ওইদিন শুধু বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করেনি, আঘাত করেছে পুরো বাংলাদেশের মানুষের ওপর। শোকে বিধ্বস্ত, হতবিহ্বল ও বোবা হয়ে পড়েছিল পুরো দেশ। আর বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে বলেছে, এও কি সম্ভব? একটি দেশ তার স্থপতি, মহান নেতাকে কীভাবে হত্যা করে? এই প্রশ্ন আর হতাশা এখনো বয়ে বেড়ায় দেশের মানুষ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারা বিশ্বে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকে প্রশ্ন তোলেন আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে। এই নিবন্ধে আজ সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরতে চাই সেসব প্রতিক্রিয়ার কিছু অংশ।
বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছো! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
‘দ্য টাইমস অব লন্ডন’-এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’
একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’
ব্রিটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’
ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়া বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’
বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’
ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথ কাউন্ডা বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামি জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।’
জাপানি নাগরিক মুক্তি ফুকিউরা বাঙালি দেখলে বলতেন, ‘তুমি বাংলার লোক? আমি কিন্তু তোমাদের জয় বাংলা দেখেছি। শেখ মুজিব দেখেছি। জানো এশিয়ায় তোমাদের শেখ মুজিবের মতো সিংহ হৃদয়বান নেতার জন্ম হবে না বহুকাল।’ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর এক দিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপলাভ করবে।’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর শোকে পাথর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে আসার জন্য জার্মানির একটি এয়ারপোর্টে তার পাসপোর্টটি ইমিগ্রেশন অফিসারকে দেখালে সেই অফিসার পাসপোর্টটি দেখেই শেখ হাসিনাকে বললেন ‘ছিঃ তোমরা বাংলাদেশিরা খুব জঘন্য একটি জাতি, যেই মানুষটি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’
১৫ আগস্ট ওই ঘটনার পর বিবিসি প্রকাশ করে, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে।’ শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্ উল্লেখ করে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পাওয়ার পর তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির এক পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’
ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছেন। মূলত এক দিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
নিউজউইকে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগে শোষক, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’
ওই ভাষণের পর কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিলে, এখন থেকে সাবধানে থেকো। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’ ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সেদিনের কথাটিই সত্য হয়ে যায় ঠিক দুই বছরের মাথায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী টাইম ম্যাগাজিন ১৯৮২ সালে উল্লেখ করে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আমল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ও প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে।’
বিখ্যাত উর্দু কবি নওশাদ নূরী তার টুঙ্গিপাড়া নামক কবিতায় বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে এভাবেই বলেছেন ‘পথের শুরুটা হয়েছিল এইখানে/পথ খোয়া গেল, হায় সেও এইখানে’। অসীম সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজ বঙ্গবন্ধুকে টাইগার অব বেঙ্গল বলে অভিহিত করেছেন। বিখ্যাত লেখক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ আঁন্দ্রে মার্লো বঙ্গবন্ধুকে বাঘের বাচ্চার সাথে তুলনা করেছিলেন। আমেরিকার প্রথাবিরোধী কবি অ্যালেন গীনসবার্গ বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতির একজন প্রকৃত নেতা মনে করতেন।
শেষ করতে চাই এই বলে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সুবর্ণ সময়গুলো অতিবাহিত হয়েছে পাকিস্তানি শোষকদের নির্জন, নিষ্ঠুর কারাগারের লৌহ কপাটের অন্তরালে। সেই জাতীয়তাবাদী নেতাকে হত্যা করতে একটুও হাত কাঁপেনি খুনি ও হন্তারকদের। তারা চেয়েছিল, বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে কিন্তু তা তারা পারেনি। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের এত বছর পরও তিনি বাঙালির হৃদয়ে চিরন্তর আসন গ্রহণ করে আছেন। তাই আজ নির্দ্বিধায় বলা যায়, মানুষের মুক্তি-সংগ্রামে নির্ভীক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অনন্যসাধারণ অবদান ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ, তাই বাঙালিরা যেমন তার কাছে ঋণী, তেমনি ঋণী বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাসও।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার বেআইনি ।
2023 DailyNews24BD.com