র্যাবের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক, বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অগ্রহণযোগ্য। কোনো দেশের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখা। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের যে চরম লঙ্ঘন করে আসছে; তাতে এই দেশটির বিরুদ্ধেই গোটা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা দেয়া উচিত।
মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশ স্বর্গ এমন দাবি কেউই করবেন না। বরং মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের নানান বিষয়ে আমার প্রবল আপত্তি আছে। বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠায় বড় অন্তরায় হয়ে আছে। পুলিশ এবং পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবের বিরুদ্ধেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি।
র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিএনপি সরকারের আমলে। সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের ক্রসফায়ার দিয়েই প্রথম আলোচনায় আসে র্যাব। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির অনেক নীতি বাতিল হলেও ‘ক্রসফায়ার’কে তারা বরণ করে নেয় সাদরে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাবের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ রয়েছে। তবে র্যাবের কৃতিত্বের তালিকাও অনেক লম্বা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, জঙ্গি দমন, নারী পাচার রোধ, মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে র্যাবের সাহসী ভূমিকা প্রশংসা কুড়িয়েছে। শুধু র্যাব বলে নয়, সব দেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কেই ভালোমন্দ অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু একটি দেশের একটি বাহিনীকে টার্গেট করা কোনো কাজের কথা নয়।
আগেই বলেছি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আমাদের প্রত্যাশার সমানন্তরাল নয়। কখনও পরিস্থিতির অবনতি হয়, কখনও উন্নতি হয়। তবে সব ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোনো দেশেই মানবাধিকার পরিস্থিতি একশভাগ সঠিক নয়।
উন্নত বিশ্বে পরিস্থিতি হয়তো কিছুটা ভালো। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় দেশে মানবাধিকারের কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন সবসময় সহজ নয়। তারচেয়ে বড় কথা হলো- যে দেশ দুই দশক সামরিক শাসনের অধীনে ছিল, তার মানবাধিকারের কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন সহজ নয়। তবে হাল ছাড়লে হবে না। সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের কথা বলে যেতে হবে।
র্যাবের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক, বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অগ্রহণযোগ্য। কোনো দেশের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখা।
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের যে চরম লঙ্ঘন করে আসছে; তাতে এই দেশটির বিরুদ্ধেই গোটা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা দেয়া উচিত। ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনী যা করেছে; তা মানবাধিকারের সংজ্ঞাকেই বদলে দিয়েছে। গুয়ানতানামো বে কারাগারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
সিআইএ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে গোপন বা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করেছে, তা মানবাধিকারের ধারণাকে বার বার দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৬ লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ রাজ্যে মানুষ চাইলেই অস্ত্র বহন করতে পারে। এই সুযোগে প্রায়শই কিছু মানুষ অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং বেপরোয়া মানুষ হত্যা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনও বর্ণবৈষম্য, জাতিবৈষম্য প্রবলভাবে বিরাজমান। কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও সে দেশে নিরাপদ নয়।
গতবছর জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার ছবি এখনও আতঙ্কিত করে মানবতাবাদী সব মানুষকে। বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের ধারণাকে কবর দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন অন্য কোনো দেশের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে, নির্দিষ্ট কাউকে নিষিদ্ধ করে; তখন মনে হয়- এক বুড়ি আরেক বুড়িকে কয় নানি।
র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে বাংলাদেশ তার অসন্তোষের কথা জানিয়েছে। মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যরাও তীব্র অসন্তোষের কথা বলছেন। তবে আমার ধারণা, র্যাবের ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিছক র্যাব সংশ্লিষ্ট নয়। এটা আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সমীকরণের ফল।
কদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলন করেছে। যে সম্মেলনে কিছু নির্দিষ্ট দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশ্বেই এক বিভক্তির সূচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ধারণার জন্যই এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায় পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করে। এমনিতে বাংলাদেশ- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ নীতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নিজেদের মতো পথ চলতে চায়।
সাম্প্রতিক নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ চীনের দিকে একটু ঝুঁকেছে। আর বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিপক্ষ চীন। তাই বাংলাদেশকে শায়েস্তা করতেই যুক্তরাষ্ট্র নানা কৌশল অবলম্বন করছে। গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো, র্যাবের ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সেই কৌশলেরই ধারাবাহিকতা মাত্র।
একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এক বড় পরাজয় স্বাধীনতার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বিজয়ের ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে সেই তলাবিহীন ঝুড়ি বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
আমরা আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা প্রত্যাশা করি উন্নয়নের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতিও উন্নতি হবে। মানুষ তার ভোট দিতে পারবে, মতপ্রকাশ করতে পারবে। কেউ বিচারবহির্ভূত কোনো অনিয়মের শিকার হবে না। সবার জানমাল নিরাপদ থাকবে। কিন্তু কোনো দেশের মাতব্বরি আসরা সইব না।
সুত্রঃ সাংবাদিক-প্রভাষ আমিন এর কলাম থেকে !