নীলফামারীঃ মানবজীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক পণ্য। খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ, প্রসাধনী, প্রযুক্তি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য— কোন ক্ষেত্রে নেই এর ব্যবহার? প্লাস্টিক যেমন মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে, তেমনি এর অপব্যবহারে সমুদ্র, নদী-নালা, খাল-বিল ও প্রকৃতিদূষণের সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বিষাক্ত পণ্য।
পরিবেশ-প্রকৃতির ক্যানসার হিসেবে পরিচিত বর্তমানে এই পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্য মেশিনে ভেঙে তৈরি হচ্ছে কুচি। আর এসব কুচি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিদেশেও রপ্তানি করে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
এদিকে যত্রতত্র পড়ে থাকা প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের পণ্য সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করায় পরিবেশদূষণ কমছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। এ ছাড়া এসব কুচি তৈরির কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই খাতের আরও বিকাশ সম্ভব বলে জানান কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নীলফামারী জেলায় দুই শতাধিক ছোট-বড় প্লাস্টিকের কুচি তৈরির কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন কাজ করেন ৪০ থেকে ৫০ জন শ্রমিক। আর এসব কারখানায় প্লাস্টিকের পুরোনো বোতল, স্যালাইনের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের কভার, সিরিঞ্জসহ বিভিন্ন প্লাস্টিকের পণ্য মেশিনে ভেঙে তৈরি করা হয় কুচি। এসব কুচি এখান থেকে সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন বড় বড় প্লাস্টিকের কারখানায়। বিদেশেও রপ্তানি করে আয় আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
সরেজমিনে জেলার কয়েকটি প্লাস্টিক কারখানায় দেখা গেছে, একদিকে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল, ভাঙা প্লাস্টিক বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে প্লাস্টিক কুচি শুকাতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। আবার কেউ কেউ সেই স্তূপ থেকে একদিকে বোতল, কোথাও স্যালাইনের ব্যাগ, কোথাও সিরিঞ্জ, কোথাও বোতলের ছিপি, আরসির বোতল ভাগ ভাগ করে রাখছেন। আর এসব প্লাস্টিকের দ্রবাদি ভাগ ভাগ করে মেশিনে ভেঙে তৈরি করা হবে কুচি।
ডোমার উপজেলার পাঙ্গা মটুকপুরের কারখানায় কাজ করার সময় কথা হয় নারী শ্রমিক কবিতা রানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল থেকে সারা দিন স্তূপের প্লাস্টিকের দ্রব্য বাছাই করে ভাগ করে রাখি। আর এখান থেকে নিয়ে গিয়ে মেশিনের মাধ্যমে তৈরি করা হয় কুচি। সারা দিন কাজ করে মজুরি পাই মাত্র দেড় শ টাকা। তবে আগে বাড়িতে সংসারের কাজ করতাম আর বসেই থাকতাম সংসারে অনেক অভাব ছিল, স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি প্রায় লাগত। বর্তমানে সংসারে অভাব নেই বললেই চলে।
বজ্রবালা রানী নামে আরেক নারী শ্রমিক বলেন, আগে সংসারে অভাব ছিল। বর্তমানে এখানে কাজ করে যা পাই তা দিয়েই আমার সংসার ভালোই চলছে।
কারখানার মেশিনচালক তপন রায় বলেন, শ্রমিকরা প্লাস্টিকের পণ্যগুলো ভাগ করে রাখেন, সেসব দ্রব্য নিয়ে এসে মেশিনে দিয়ে কুচি তৈরি করা হয়। এরপর এসব কুচি ওয়াশ মেশিনে পরিষ্কারের পর রোদে শুকানো হয়। পরে বস্তায় ভরে প্যাকেট জাত করা হয় বিক্রির জন্য।
এক সময় সংসারে অভাব ছিল সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুরের অশুরখাই গ্রামের শ্রমিক আতিয়া পারভীনের। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকম দিন পার করতেন। এখন প্লাস্টিক করাখানায় কাজ করে দৈনিক আয়ের একটা পথ তৈরি করেছেন।
আতিয়া পারভীন বলেন, স্বামী মারা যাওয়ায় অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতাম। তিন সন্তানকে নিয়ে এক বেলা খেয়ে, আরেক বেলা না খেয়ে কোনো রকমে দিন কাটত। কিন্তু এখন প্লাস্টিক বর্জ্য কারখানায় কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছি।
কারখানার মালিক কমল রায় বলেন, বিভিন্ন ভাঙারির দোকান থেকে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের পণ্য কাঁচামাল হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। কুচিগুলো আমরা মিলারদের কাছে বিক্রি করে থাকি। কুচির আবার বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন আরসি বোতলগুলোর নাম পেট। আর এই বোতলের কুচি যায় বিদেশে। দেশেও বিক্রি হয়ে থাকে। আর এই পেট দিয়ে দামি সুতা তৈরি হয়। মোটা প্লাস্টিক থেকে তৈরি হয় মিকশ্চারি। হালকা প্লাস্টিকের পণ্য দিয়ে তৈরি হয় চুড়ি রাখার পানিহাট। হাইব্রজ দিয়ে তৈরি হয় বদনা আর পিপি দিয়ে তৈরি হয় প্লাস্টিকের দড়ি।
তিনি আরও বলেন, ইউটিউব দেখে দেখে তিনি এই কারখানা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্লাস্টিকের কুচি তৈরির মেশিনের দাম খুব একটা বেশি না হওয়ায় এখন অনেকেই এই কুচি তৈরির কারখানার প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।
ব্যবসায়ী মিথুন রায় বলেন, আমিও কুচি তৈরি কারখানা শুরু করব কিছুদিনের মধ্যে। শুনেছি অল্প পুঁজিতে এই কারখানা দেওয়া যায়। বড় জায়গা না পাওয়ায় আপাতত শুরু করতে পারছি না। তবে জায়গা পেলেই খুব তাড়াতাড়ি শুরু করব।
কীভাবে প্রক্রিয়াজ করা হয় প্লাস্টিক, জানতে চাইলে সৈয়দপুরের বাঙ্গালীপুরের একটি কারখানার মালিক ইমরান হোসেন জানান, বিভিন্ন ভাঙারির দোকান থেকে তারা প্লাস্টিকের পুরোনো বোতল কেনেন প্রতি কেজি ২০ টাকা দরে। অন্যান্য প্লাস্টিক সামগ্রী কেনেন ৩৫ টাকা কেজি দরে। তারপর এগুলো মেশিনের সাহায্যে পানি দিয়ে ওয়াশ করেন। পরে মাড়াই করে প্লাস্টিকের কুচি মেশিনের মাধ্যমে শুকিয়ে বস্তায় ভরে সরবরাহ করা হয়। সরকারি সহযোগিতা পেলে এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটানো যেত বলে মনে করেন তিনি।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, প্লাস্টিক মাটির সব থেকে বড় শত্রু। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাবে দিন দিন ফসল কমে যাচ্ছে। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে কুচি তৈরি হওয়ার কারণে পরিবেশ রক্ষা পাবে। প্লাস্টিকের কুচি পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছি।
পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের কুচি পরিবেশের উপকার করছে জানিয়ে জেলা জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী মুরাদ হোসেন বলেন, কুচি তৈরির কারণে মানুষজন এখন প্লাস্টিকের অব্যবহৃত পণ্য ফেলে না দিয়ে সংগ্রহে রেখে বিক্রি করে। যা মাটির জন্য অনেক উপকার পরিবেশের জন্যও স্বস্তিদায়ক।
পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুরের সহকারী পরিচালক বিজন কুমার রায় বলেন, যত্রতত্র পড়ে থাকা প্লাস্টিকের দ্রবাদি পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। আর এই ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে পরিবেশ তার দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। পাশাপাশি এসব কারখানায় কাজ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার বেআইনি ।
2023 DailyNews24BD.com