চারিদিক লোকে লোকারণ্যে বর্ণাঢ্য রং–বেরঙের পোশাকে সুসজ্জিত জনতা, মনে হলো সারা বাংলাদেশ এসে সমবেত হয়েছে বটমূলে এক জাতীয় উত্সবে—নববর্ষের প্রাণপ্রাচুর্যের এক উজ্জীবিত আনন্দোত্সব। রমনার ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আজ এক মহোত্সবে পরিণত হয়েছে।
দেখতে দেখতে ৪২ বছর কেটে গেল। স্বভাবতই মনে পড়ে প্রথম বছরের কথা। ১৯৬৭ সালে বাঙালি সংস্কৃতির আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মনে পড়ে সরকারি হামলা ও তার প্রতিবাদী অভিব্যক্তির কথা। থমথমে ভাব চারদিকে। আজিমপুরে সন্জীদাদের (ড. সন্জীদা খাতুন) ফ্ল্যাটে শুনি সেই প্রতিরোধী বজ্রকণ্ঠ। ছায়ানটের সভা বসেছে। সভায় ঠিক হলো, প্রতিবাদ হিসেবে নববর্ষের অনুষ্ঠান হবে উন্মুক্ত ময়দানে, সর্বসাধারণের সমাগমে। সন্জীদা প্রস্তাব করলেন, কোনো বড় গাছের নিচে অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা। ওয়াহিদুল হক এতে সায় দিয়ে আমার দিকে তাকালেন, ‘চেনা কোনো জায়গা আছে?’ হঠাৎ মনে পড়ে গেল, রমনা পার্কের মহিরুহ অশ্বত্থের কথা। দোয়েল পাখির ছবি তুলতে গিয়ে একদিন গাছটার সন্ধান পাই। চারদিক তখন ছিল জংলি ঘাসে আচ্ছাদিত আর বেশ নিভৃত ছিল জায়গাটা। ছায়ানটের কর্মকর্তাদের বললাম গাছটার কথা। সেদিনই শেষ বিকেলে ওয়াহিদুল, সন্জীদা, কমল সিদ্দিকী, পিয়ারু (আনুয়ারুল হক) ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে গেলাম গাছ দেখতে। সবার পছন্দ হলো। কিন্তু বেশ পরিষ্কার করে নিতে হবে গাছের গুঁড়ির চারধার আর কেটে নিতে হবে জংলা আগাছা।
জায়গা তো পছন্দ হলো। কিন্তু কী করে ওখানে অনুষ্ঠান করা যায়? জায়গাটা সরকারি। অনুমতি চাইতে গেলে নির্ঘাত পণ্ড হয়ে যাবে সবকিছু। বিপদ এড়ানোর একটা পথ বের করা হলো। উল্লিখিত জায়গার সন্নিকটেই রমনা রেস্টুরেন্ট। মোয়াজ্জেম ভাই (মোয়াজ্জেম আহম্মদ চৌধুরী) তখন সম্পূর্ণ ভার নিয়েছেন রেস্তোরাঁ পরিচালনার। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হলো, রেস্তোরাঁ আয়োজন করবে পয়লা বৈশাখের এক বিক্রয় মেলা। কাগজের ঠোঙায় মুড়ি-মুড়কি ও অন্য খাবারদাবার রেস্তোরাঁর সামনে সাজিয়ে বিক্রয় করা হবে। পুলিশ বা সরকারি লোক এলে যেন বলা যায়, রমনা রেস্টুরেন্টই আয়োজন করেছে বৈশাখী অনুষ্ঠানটা।
তাড়াহুড়ো করে ছায়ানট আমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে ফেলল। অনুষ্ঠানের স্থান: রমনার বটমূল। আসলে কিন্তু গাছটা বট নয়, অশ্বত্থ। তাতে কী আসে যায়—দুটোই ঘনিষ্ঠ প্রজাতি! পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতের আঁধারে মাইক লাগানো হলো। মধ্যরাত পর্যন্ত খেটে পিয়ারু, আনোয়ার জাহান এবং আর্ট কলেজের কয়েকজন মিলে মঞ্চ তৈরি করল। কমল সিদ্দিকী গাছের পোকা মারার জন্য রাতের বেলায় কয়েক দফা স্প্রে করে ফেলল—সন্জীদার কড়া নির্দেশ, গানের সময় শিল্পীদের গায়ে যেন পোকামাকড় না পড়ে। তা হলে গান সব পণ্ড হয়ে যাবে। বেচারি কমল বারবার আমার কাছে আসে পরামর্শের জন্য।
বসার জন্য সে রকম ভালো ব্যবস্থা করা যায়নি সময়ের অভাবে—না শিল্পীদের, না শ্রোতাদের জন্য। তবু যথাসময়ে তানপুরায় নববর্ষের শুভাগমনকে সাদর সম্ভাষণ জানানো হলো। আমাদের বুক ঢিপ ঢিপ করছে। হঠাৎ যদি পুলিশের আবির্ভাব হয়।
…ফুরফুরে হাওয়া বইছে। অশ্বত্থের কচি পাতা ঝিলমিল করছে। নুয়ে পড়া ডালপালা দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে। মাইক্রোফোন বাঁধা ডালটাই যেন বেশি দুলছে। জাহেদুর রহিমের অগ্রণী বলিষ্ঠ কণ্ঠে সমবেত সুরে ভেসে এল:
‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো। /তাপস নিশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, / বত্সরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।// যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি, /যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।’
‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও। /আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও//যেজন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে//আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে/এই অরুণ আলোর সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দাও…’
বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের আগেও পঞ্চাশের দশকের দিকে ঢাকা শহরের কিছু কিছু বাড়িতে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান লক্ষ করা যায়। পঞ্চাশের শেষের দিকে নাসিরুল হক সাহেব তাঁর আরমানিটোলার হাসিনা হাউসে বর্ষবরণের আয়োজন করেছিলেন। অনুষ্ঠানকক্ষ কৃষ্ণচূড়ার ফুলের বড় বড় গুচ্ছ দিয়ে সাজানো হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে অনেকে গান গেয়েছিল ও নেচেছিল। এতে কলিম শরাফী এবং ঐকতানের অনেক নবীন শিল্পীও অংশ নিয়েছিল। এ ছাড়া হুসনেআরা মাক্কীর ফ্ল্যাটেও নববর্ষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে সংস্কৃতিমনা বহু যুবক-যুবতী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সমাগমে এক শুভ্র–সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হতো।
পয়লা বৈশাখে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৩৭০ সনের সকালবেলা। সে অনুষ্ঠানে বিদ্যায়তনের উদ্বোধনের ব্যাপার ছিল বলে অনুষ্ঠান হয়েছিল তখনকার ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে। পরে এরই নাম হয় উদয়ন স্কুল। পরের বছর অনুষ্ঠান হলো প্রাঙ্গণের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। সেটা হলো সন্ধ্যাবেলায়। লাল কৃষ্ণচূড়ার স্তবক সজ্জিত শাখা-প্রশাখার নিচে তৈরি হতো মঞ্চ।
পয়লা বৈশাখ প্রভাতে রমনার বটমূলে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হবার, উজ্জীবিত হবার পুণ্যস্থানে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে বটমূলের প্রাঙ্গণ ছাপিয়ে ছড়িয়ে গেল চারদিকে। বাংলা একাডেমিতে পয়লা বৈশাখের মেলা, শিল্পকলা একাডেমিতে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান, ঢাকা শহরের আনাচ-কানাচে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ছড়িয়ে গেল। কেবল রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ রইল না এই বর্ষবরণ উত্সব। যশোর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, গাজীপুর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সর্বত্র নতুনকে স্বাগত জানানোর উত্সব পয়লা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় উত্সব।
বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখ এক সর্বজনীন উত্সব। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্য কোনো গোষ্ঠীর অনুষ্ঠান নয়, বরং সব বাঙালির প্রাণের উত্সব। আদিবাসীদের বৈশাখী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শহরবাসীর অনুষ্ঠানকে আরও উজ্জীবিত করে তোলে।
১৯৮৯ সাল থেকে চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা পশুপাখি আর অন্যান্য বিচিত্র চেহারার মুখোশ তৈরি করে মঙ্গল শোভাযাত্রার আনন্দে মেতে ওঠে। বিশাল এলাকায় পথজুড়ে ছেলে-মেয়ে-শিশু-বুড়োর পদচারণে মুখর হয়ে উঠল। হাতে বেলুন, একতারা, ছোট ডুগডুগি আর প্রাণের আনন্দ-উচ্ছলতা, মুখোশ, শোভাযাত্রার আগে আগে জয়ঢাকে প্রাণঢালা তালে তালে নেচে নেচে সবাই অগ্রসর হচ্ছে। এখানেই সেই মঙ্গলযাত্রা থেমে যায়নি। প্রতিবছরই সকালবেলা এই শোভাযাত্রার জয়ঢাকের আওয়াজে ঊর্মিমুখর হয়ে ওঠে। এখন ঢাকা শহর ও অন্যান্য শহরে নগরবাসী শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলায় উদ্বেলিত হয়ে থাকে। এসব মেলা গ্রামীণ মাটি, কাঠের পুতুল ও নানা রকম সরঞ্জামে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই আনন্দ–উত্সব। কোনো কোনো মেলা চলে সপ্তাহজুড়ে।
ঢাকার বাইরে বিশেষ করে চট্টগ্রামে নববর্ষের আনন্দ–অনুষ্ঠান কয়েক দিন ধরে চলে। বাঙালি জীবনে খোলা আকাশের নিচে মেলামেশা, প্রিয়জনদের বই কেনার এই সুযোগ অধিকতর বাঙালি হওয়ার এক নিরন্তর হাতছানি। গড়ে উঠল ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নদীর ধারে উন্মুক্ত মঞ্চ। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরপর সেখানে নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ করেছে। তেমনই রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি সুপ্রতিষ্ঠিত। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মিলবার এ আয়োজন। শান্তিপ্রিয় সহাবস্থানে অভ্যস্ত বাঙালির অতীত ঐতিহ্যকে জাগ্রত করেছে আবার।
ধানমন্ডিতে লেকের ধারে ধারেও বহু অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। গান, নাচ ও মেলার ঝংকারে চারদিক উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। শাবাশ বাংলাদেশ! ৪২ বছরে হাজার থেকে লাখে লাখে জনসমুদ্র। প্রবীণ-নবীনের উদ্দীপিত সমাবেশ। রাস্তার ওপারের উদ্যানেও জনসমুদ্র আজ ভেঙে পড়েছে। জাতি-ধর্মনির্বিশেষের জনতা: আমগাছটার নিচে একদল চাকমা তরুণীর কুন্তলে কৃষ্ণচূড়া সুশোভিত। সিঁথির সিঁদুর আলোকিত করে দাঁড়িয়ে আছে নববধূ স্বামীর গা ঘেঁষে। নাগেশ্বরগাছটার নিচে হঠাৎ দেখা বেতাগীর সঞ্জু, মিনতী, রিন্টি, শোভন ও সুহাস বড়ুয়ার সঙ্গে। উচ্ছ্বাসে মেয়েদের খোঁপায় বেলি ফুলের মালা দুলে দুলে উঠছে। ধবধবে পাঞ্জাবি-পায়জামায় নবীনরা ঊর্মিমুখর। সুশীতল গাছের তলে তলে বসেছে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের চড়ুইভাতির চক্র। ধানমন্ডি লেকের ধারে চলে কয়েক ঘণ্টা বুলবুল একাডেমির মনমাতানো অনুষ্ঠান। সেখান থেকে শিল্পীদের সমবেত সুরে ভেসে আসছে আবার:
‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে
আগুন জ্বালো
একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই
পথের আলো
আগুন জ্বালো…’
বৈশাখের নববর্ষ অনুষ্ঠান অতি প্রাচীন। ভারতীয় উপমহাদেশে সাচ্চীর তোরণে তার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৈশাখী ও সংক্রান উত্সব। বার্মার ১২ শতকের দি গ্লাস প্যালেস ক্রনিকলে সংক্রান ও বৈশাখী অনুষ্ঠানের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। চৈত্র সংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ প্রাচীন বৌদ্ধ ক্যালেন্ডারে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। এই দুই উত্সবের উল্লেখ আছে বার্মা (এখন মিয়ানমার), থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার নথিপত্রে। বর্তমানে তিন দিনের এই অনুষ্ঠান এসব দেশে এখনো সাড়ম্বর পালিত হয়ে থাকে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় ও জাতীয় পর্যায়ে। এমনকি সরকারিভাবেও এ অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। তিন দিন সরকারিভাবে অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। এই সংক্রান, বৈশাখী ও পিমাই (লাওসে) অনুষ্ঠানের আরেক জনপ্রিয় নাম জলকেলি বা ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল। এমন উচ্ছল ও আনন্দময় সর্বজনীন অনুষ্ঠান পৃথিবীর খুব কম জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এমনকি ব্রাজিলের বিখ্যাত মারদিগ্রাস ফেস্টিভ্যালও এর কাছে হার মানে। কারণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংক্রান বা বৈশাখী অনুষ্ঠান চলে সাত দিন ধরে সমগ্র দেশে—শহর ও গ্রামে।
থাইল্যান্ডের রামকেন হেঙয়ের ১২ শতকের রাজধানী সুখোথায় (সুখের উদয়) দুটো উত্সবের বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। কার্তিক মাসের লয়ক্রাতন ও বৈশাখের সংক্রান উত্সবের।
পয়লা বৈশাখ শুভ্র প্রভাতে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে জীবনের পথে চলার এক বিরাট অনুপ্রেরণা। বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার পথের বাধা ভাঙার প্রতীতি আমাদের আরও বলীয়ান করে তোলে প্রতিটি পয়লা বৈশাখে।
আজ পয়লা বৈশাখের সুপ্রভাতে রমনার বটমূল বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়ার, উজ্জীবিত হওয়ার পুণ্যস্থানে পরিণত হয়েছে।
‘নব আনন্দে জাগো আজি নবরবি–কিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি উজ্জ্বল নির্মল জীবনে…’
সূত্র: প্রথম আলোর লেখক প্রয়াত আলোকচিত্রশিল্পী নওয়াজেশ আহমদ লেখা অবলম্বনে