ভৌগলিক অবস্থানে বাংলাদেশ বিশ্বের সবথেকে বড় মার্কেটের কোল ঘেষে রয়েছে। অবিশ্বাস করবার অবকাশ নেই যে, আগামীর বিশ্ব শাসন করবে এশিয়া। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলে সেটি স্পষ্ট।
জনসংখ্যা ও অর্থনীতির আকার বিবেচনায় চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া তথা গোটা বিশ্বের অর্ধেক মানুষের বিশাল বাজার ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশকে ঘিরে। এত বড় কনজিউমার মার্কেট আর কোথাও নেই। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই অঞ্চল এখনো পিছিয়ে আছে বটে।
তবে দুই বছর আগে বাংলাদেশের সামনে ছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যত যেটা বার্মাকে নিয়ে আগের লেখায় ব্যাখ্যা করেছি। NLD এর কাঁধে ভর করে বার্মা যখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের জন্য সেটা ছিল অনেকটা 'চেয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই' অবস্থা। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বার্মার তিক্ত অতীতকে পাশ কাটিয়ে ধেয়ে আসছিল বিদেশি বিনিয়োগ। কয়েক বছরের ভেতরেই বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের থেকে বার্মার বৈদেশিক বিনিয়োগ বড় অঙ্কে ছাপিয়ে যায়।
বার্মা দেশ হিসাবে বাংলাদেশের ৫ গুন বড়। কিন্তু অর্থনীতির আকার $৭০ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতির আকার বিবেচনায় বাংলাদেশ বার্মার থেকে প্রায় ৬ গুন বড়। অথচ বার্মাতে গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে বিনিয়োগে আস্থা ফিরে এলে ইউরোপ, জাপান, চীন, ভারতসহ অনেক দেশ বিলিয়ন ডলার নিয়ে হাজির হয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের নেট বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল মাত্র $২.৩৩ বিলিয়ন। অথচ ২০১৬ সালে বার্মায় নেট বৈদেশিক বিনিয়োগ আসে $৩.৮২ বিলিয়ন! জাপানের বিনিয়োগ ছিল সবথেকে আকর্ষনীয়।
বার্মার সবথেকে বড় ইকোনমিক জোন তিলাওয়া স্পেশাল ইকোনমিক জোনের কাজ শুরু করে জাপান। গাড়ি নির্মান থেকে শুরু করে হরেক রকমের ভারী শিল্পের বিনিয়োগে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে বার্মা। জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবের ২০১৩ সালে বার্মা সফরে প্রায় ৪০ টি কোম্পানির টপ এক্সিকিউটিভ সফরসঙ্গী হন। এরপর ধেয়ে আসে জাপানের বিনিয়োগ। সরাসরি জাপানের বিনিয়োগ পৌছায় $২.৭ বিলিয়ন ডলারে। এর ভেতর $৭০০ মিলিয়ন ডলারে ইয়াঙ্গুনে (সাবেক রেঙ্গুন) গড়ে উঠে ২৪০০ হেক্টরের বিশাল স্পেশাল ইকোনমিক জোন।
বিনিয়োগে নেতৃত্ব দেয় জাইকা, মিতশুবিশি, সুমিতোমো ও মেরুবিনি। বিখ্যাত টয়োটা কোম্পানি এই জোনে $৫২.৬ মিলিয়ন ডলারে একটি কারখানা করে যেখান থেকে হাইলাক্স পিক-আপ ট্রাক উৎপাদন শুরু হয়। সুজুকি তাদের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৪ গুন বাড়ায়ে ৪০,০০০ গাড়ি করে। সিনজো আবের ইকোনমিক পলিসিতে "থাইল্যান্ড প্লাস ওয়ান" হিসাবে বার্মাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। মুলত থাইল্যান্ডে জাপানের বিশাল বিনিয়োগের সাপ্লাই চেইন শক্ত ও সাশ্রয়ী করা ছিল জাপানের উদ্দেশ্য।
বার্মায় ব্যাবসা করা সহজ ছিলনা। কিন্তু জাপান সেই পথকে সহজ করতে থাকে। সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে জাপানিজ কোম্পানির বিনিয়োগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায়। টেলিকমে বিনিয়োগ আসে $২ বিলিয়ন ডলার। এখানেই শেষ নয়। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম উন্নয়ন করে দেয় জাপান। $১.৬৩ বিলিয়ন দেয় শুধু সাহায্য হিসাবে। সেই সাথে প্রায় $৩ বিলিয়ন ডলারের ঋন মওকুফ করে জাপান! লেনদেন ঠিক রাখতে জাপানের বৃহৎ তিনটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয় বার্মায়! জাপানের 'থাইল্যান্ড প্লাস ওয়ান' পলিসির মত চীন ও বার্মায় প্রচুর বিনিয়োগ করতে থাকে। বিশেষ করে কথিত স্ট্রিং অব পার্লস বা বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে রাখাইনে গভীর সমুদ্র বন্দর ও অন্যান্য অবকাঠামোয় বিলিয়ন ডলার ঢালতে থাকে চীন।
কম যায়না দক্ষিণ কোরিয়াও। দল বেধে ঝাপিয়ে পড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলি। রেডিমেড গার্মেন্টস থেকে শুরু করে কৃষি, প্রায় সব সেক্টরে বিনিয়োগ করে দক্ষিণ কোরিয়া। সেই সাথে ধেয়ে আসে ইউরোপীয়ান বিনিয়োগ। আর এসব বিনিয়োগে বার্মা ক্রমেই গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব আনতে থাকে। আর এখানেই হুমকিতে পড়ে বাংলাদেশ। মজুরি বাংলাদেশের থেকেও কম হবার কারনে দ্রুতই বার্মায় গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি পরিচিত নাম হতে থাকে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের বেশ উত্তম বিকল্প অপশন হিসাবে প্রতিষ্ঠার পথে ছিল বার্মা। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো করে দেয় সামরিক শাসন। শুরু হয় অবরোধ। ইউরোপ তাদের বিনিয়োগ ফেরাতে থাকে। অন্যদেশগুলির বিনিয়োগ থমকে যায়। যেখানে ২০১৬ সালে বার্মায় FDI ছিল $৩.৮ বিলিয়ন সেখানে ২০২১ এ বৈদেশিক বিনিয়োগ হয় $০.০০ ডলার। অর্থাৎ ২০২১ এ বার্মায় কোন বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়নি। ধীরে ধীরে কারখানা সব বন্ধ হতে থাকে। গার্মেন্টস কারখানা গুলি লোকসানে পড়ে একে একে বন্ধ হয়ে যায়।
এবার আসি শ্রীলংকা প্রসংঙ্গে। বেহিসাবি বড়লোকি দেখাতে গিয়ে এই অঞ্চলের শ্রেষ্ট অর্থনীতি এখন দেউলিয়া। জ্বালানির অভাবে দেশটিতে এখন দিনে ১৪-১৫ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকেনা। কারখানা বন্ধ। ভয়ানক প্রভাব পড়েছে চীনের পর দ্বিতীয় বৃহৎ চা রপ্তানির দেশ শ্রীলংকার চা খাতে। সেই সাথে টেক্সটাইল ও এপারেলস সেক্টর দেউলিয়ার বিষাক্ত ছোবলে পড়েছে।
এই পরিস্থিতির পূর্ন সুবিধা পাচ্ছে ভারত। শ্রীলংকার উৎপাদিত এপারেলস পণ্যের অধিকাংশ হাই এন্ড প্রোডাক্ট। এগুলার অর্ডার অটো চয়েস হিসাবে চলে যাচ্ছে ভারতে। খুব পরিকল্পনা মাফিক ভারত তাদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিকে বিশ্বমানে নিতে পেরেছে। অরবিন্দ, রেমন্ড, ট্রাইডেন্ট এর মত বিখ্যাত ব্রান্ড দাড় করিয়েছে তারা। স্পেশালাইজড পণ্যে তাদের অগ্রগতি অনেক। যেমন কিডসওয়ার বা বাচ্চাদের পোশাক। ইন্ডিয়ার প্রধান শক্তি হল তারা বিশ্বে তন্তু (ফাইবার) উৎপাদনে দ্বিতীয়। মোট ফাইবারের ৬০% কটন বা তুলা। বাকিটা পাট, রেশম (সিল্ক), ও ম্যান মেড ফাইবার। নিজেদের কাঁচামালে সয়ংসম্পূর্নতা ভারতকে বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টেক্সটাইল ও এপারেলস শিল্পে ভীন্নতা এসেছে ঠিকি কিন্তু সেটা অপ্রতুল। এখনো আমাদের মোট পণ্যের ৯০% এর বেশি তুলা বা কটন ভিত্তিক। MMF এ আমরা এতদিনেও বড় বিনিয়োগ করিনি। সম্প্রতি এর গুরুত্ব বুঝতে পেরে দেশের শিল্পগ্রুপ গুলি প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা ম্যান মেড ফাইবারে বিনিয়োগ করছে বা পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা হওয়া উচিত ছিল প্রোএক্টিভ; রিয়েক্টিভ নয়।
পাট তন্তুর পোশাকে ভারত বিশ্বে প্রথম। অথচ আমরা ছিলাম পাট ও পাটজাত তন্তু উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম। বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে যখন আদমজী বন্ধ হয়, একি সময়ে বিশ্বব্যাংক ভারতের পাট শিল্পের বিকাশে বিশাল বিনিয়োগ করেছিল। বর্তমানে আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ টেক্সটাইল ও এপারেলস শিল্পে ভাল করছে।
সব মিলিয়ে এই অঞ্চলে বার্মার উত্থান থেমে গেছে। শ্রীলংকার ও কষ্টদায়ক পরিনতি হয়েছে। এই মুহুর্তে ক্যাপাসিটির ঘাটতির কারনে হয়ত ভারত আমাদের থেকে এগিয়ে থাকবে। তবে এখনি সময় আমাদের। এরকম সুযোগের যতটুকু আমরা কাজে লাগাতে পারব ততটাই লাভ।
বাংলাদেশ যদিও জাপানের বিগ বি পরিকল্পনায় রয়েছে, তবে পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় আমরা বিনিয়োগ টানতে পারছি কম। ২০১৯ এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে যেখানে FDI এসেছে $২.৯ বিলিয়ন, সেখানে চীনে $১৪১.২ বিলিয়ন, ভারতে $৫০.৬ বিলিয়ন, ইন্দোনেশিয়ায় $২৩.৯ বিলিয়ন ও ভিয়েতনামে $১৬.১ বিলিয়ন বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছিল। আমরা এখানে অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের পলিসি বদলাতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
লেখক : তৈয়বুর রহমান, বিজনেস এডিটর, ডেইলিনিউজ২৪বিডি.কম
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার বেআইনি ।
2023 DailyNews24BD.com