পাবনা জেলাজুড়ে চলছে টসটসে রাজভোগ লিচুর বিকিকিনি। তবে এ জেলায় লিচুর রাজধানী হিসেবে খেতাব পেয়েছে ঈশ্বরদী উপজেলা। বাগান থেকে বিভিন্ন জাতের লিচু ভাঙা, গণনা করা, ঝুঁটি বাঁধা, ঝুড়ি করা, ক্যারেট ও প্যাকেট করা- সবকিছুই এখানে হয়ে থাকে। পরে তা ট্রাকযোগে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশ-বিদেশে। ভালো ফলন আর ভালো দাম পেয়ে চাষিরা এখন খুশিতে মাতোয়ারা। বাগান, আড়তদার, ছোট-বড় বাজার ও মোকামের পাশাপাশি লিচুর আনাগোনা বেড়েছে বিভিন্ন পার্সেল বা কুরিয়ার সেন্টারেও।
এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে লিচু। বিভিন্ন জেলার পাইকার ব্যবসায়ীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাগান মালিক বা মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে লিচু ক্রয় করে নিচ্ছেন। পাবনায় লিচু বিক্রির সবচেয়ে বড় হাট ঈশ্বরদী উপজেলার আওতাপাড়া। ভোরের আলো ফোটার আগেই হাটে শুরু হয় বেচাকেনা। চলে সকাল ৮টা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে বাজারে আটির লিচুর পাশাপাশি বোম্বাই লিচু ও চায়না জাতের লিচু চলে আসছে। মোজাফফর জাতের লিচু বাজারে ব্যাপক পাওয়া যাচ্ছে। জাতভেদে লিচুর দাম সহনশীল হলেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে এবারও দাম নিয়ে রয়েছে নানা মতপার্থক্য। কেউ বা এটি স্বাভাবিক বলছেন। কেউ বা চড়া বা নিম্নগামী হিসেবে দাবি করছেন। তবে জেলার ঈশ্বরদী, আটঘরিয়া, চাটমোহর, সুজানগর, পাবনা সদরের বিভিন্ন এলাকায় ও বাগানে গিয়ে বাগান মালিক, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে তারা লিচুর ফলন ও দামে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বাগান ও হাটবাজারে বাগান মালিক এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে ১২শ' টাকা থেকে শুরু করে ১৮ টাকায় লিচু বিক্রি হচ্ছে। জাতভেদে কোথাও কোথাও ২ হাজারের উপরে পাইকারি লিচু বিক্রি হচ্ছে। খোলাবাজারে ১৬০ থেকে ২৫০ টাকায় লিচু বিক্রি হচ্ছে। লিচুর এই রাজধানীজুড়ে বিদেশি হাইব্রিড বোম্বে লিচু ও দেশীয় আটি জাতের লিচুর বাগান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা দেশীয় প্রজাতির আটির লিচু ভেঙে ফেলেছেন। বোম্বাই লিচু ভাঙা শুরু করেছেন। ছোট-বড় সব হাটবাজারই মৌসুমি এই লিচুর সমারোহ শোভা পাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর, মানিকনগর, জয়নগর, মিরকামারি, আওতাপাড়া, বাঁশেরবাদা, সদর উপজেলার চকউগ্রগড়, জোয়ারদহ, হামিদপুর, জয়কৃষ্ণপুর, উগ্রগড়, মৌগ্রাম, আটঘরিয়া উপজেলার গোপালপুর, ত্রিমোহন, পরানপুর, হিদাশকোল, চাচকিয়া, ষাটগাছা, ডেঙ্গারগ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে সারিসারি এমন লিচুর বাগান। সারাদেশের লিচুর চাহিদার একটি বড় যোগান আসে এসব গ্রাম থেকে। প্রতি বছর ৬ থেকে ৭শ' কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয় এই জেলা থেকে। ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলার ঈশ্বরদী পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে লিচু গাছ রয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০টি। বিঘাপ্রতি ২০টি থেকে ১৫টি গাছ অর্থাৎ ১ একর জমিতে ৪২টি, ১ হেক্টর জমিতে ৯০টি গাছ রোপণ করা হয়েছে। লিচু আবাদি কৃষকের সংখ্যা ৯ হাজার ৬২০ জন। বাণিজ্যিক আকারে বাগান ২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। বিচ্ছিন্ন ভাবে বসতবাড়িতে আবাদ রয়েছে ৫৫০ হেক্টর। ফলন্ত আবাদি জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমি। এদিকে ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার ভরা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিন সকাল ১০টা বাজতে না বাজতেই ঈশ্বরদীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি অতিক্রম করে, দুপুর নাগাদ ৩৬ থেকে ৩৮-৪০ ডিগ্রির মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। এই আবহাওয়া লিচুর জন্য প্রতিকুল। ফলে গাছে প্রচুর লিচু আসলেও আকারে ছোট হয়েছে। ঈশ্বরদীর চরমিরকামারী লিচু চাষি ঈসমাইল হোসাইন সরদার জানান, তার ১২ বিঘার উপরে একটি লিচু বাগান আছে। প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেন তিনি।
এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। আটিজাতীয় লিচুর দাম আমানুরূপ একটু কম হলেও বোম্বাই লিচুতে অধিক দাম পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তিনি। ঈশ্বরদীর জয়নগর হাটে কথা হয় আওতাপাড়ার লিচু চাষি বাদশা মোলস্নার সঙ্গে। তিনি বলেন, ৩০ বিঘা জমির উপর ৭৮ টি লিচু গাছ রয়েছে। ১০ বিঘা জমিতে আটি জাতের লিচুর আবাদ রয়েছে। বাকি বাগানগুলোতে বোম্বাই লিচু চাষ হয়েছে। আটি জাতের লিচুর মধ্যে ৬ বিঘা লিচু বাজারে এনে বিক্রি করে দিয়েছি। দাম কম হলেও ফলন ভালো হওয়াতে খরচ যোগাতে তেমন সমস্যা হবে না। আওতাপাড়া হাটে কথা হয় বরিশাল থেকে আসা বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'প্রতি বছরই আমি এখানে এসে লিচু কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে থাকি। আমার এসব লিচু খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিলস্না অঞ্চলে পাঠানো হয়। এবার বাগানে ফলন ভালো হওয়ায় বাজারে প্রচুর লিচু আসছে। দামও মোটামুটি নাগালের মধ্যেই আছে।'
এদিকে লিচু ভাঙতে প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। এতে অনেক বেকার যুবক ও শিক্ষার্থীদের আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে লিচু বাগানে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রমিকের কাজ করছে। বাড়ির অনেক বয়স্ক, মধ্যবয়সি নারীদেরও লিচুর পাতা ছেঁড়ার কাজ করতে দেখা গেছে। আসমা খাতুন নামে এক নারী বলেন, 'এ সময় বাড়িতে তেমন কাজকর্ম নেই, তাই বাড়ির পাশে লিচু বাগানে আটি বাঁধা ও পাতা ছেঁড়ার কাজ করছি। সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত এখানে কাজ করে ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা পাই।' ঈশ্বরদীর বাঁশেরবাদা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহান বলেন, 'এখন আমার স্কুল ছুটি রয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাই ছুটির মাঝে লিচুর বাগানে কাজ করছি। প্রতিদিন ৫শ টাকা করে হাজিরা পাই। এতে পড়ালেখার কিছু খরচ জোগাড় হয়।' জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিচালক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বলেন, পাবনায় ৪ হাজার ৭৩১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। এতে ৪০ হাজার ২৩২ টন লিচুর ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু ফলন ভালো হওয়ায় সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর লিচুর রাজধানী খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদী। এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল লিচু, এটা চাষ করেই অধিকাংশ মানুষের সারা বছর তাদের সংসার চলে। গত বছরে ফলন ভালো না হওয়ায় চাষিরা খুব একটা লাভবান হননি, কিন্তু এবার ফলন ভালো হওয়ায় চাষিরা বেশ লাভবান হবেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার বেআইনি ।
2023 DailyNews24BD.com