ঢাকাসোমবার , ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • অন্যান্য
  1. অর্থনীতি
  2. আন্তর্জাতিক
  3. খেলাধুলা
  4. জাতীয়
  5. জীবনধারা
  6. বিজ্ঞান-প্রযুক্তি
  7. বিনোদন ভুবন
  8. বিবিধ
  9. ভিডিও নিউজ
  10. রাজধানী
  11. রাজনীতি
  12. শিক্ষা
  13. সর্বশেষ
  14. সারাবাংলা
  15. স্বাস্থ্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের কারণ

বিজনেস ডেস্ক । ডেইলিনিউজ২৪বিডি.কম
মে ১৩, ২০২২ ১:৪৮ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

শ্রীলঙ্কা আজ চরম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পতিত। দেশটি আজ ঋণের ভারে জর্জরিত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোঠায়। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিদেশ থেকে আমদানি করতে পারছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব এবং দিনে ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং নাগরিকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকট কেবল অর্থনীতি নয়, গোঁটা রাষ্ট্র এখন চরম সংকটে । জনগণ রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। বর্তমানে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে এবং দেশটি একটি চরম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।

জনগণ আস্থা হারিয়ে রাস্তায়

শ্রীলঙ্কা মধ্যমআয়ের একটি দেশ। আগে অনেক সামাজিক সূচকে শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল। এমনকি শিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পূর্ব এশিয়ারও অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল। প্রশ্ন উঠছে, শ্রীলঙ্কা কীভাবে এই চরম সংকটে পতিত হলো? সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কি কোনো ত্রুটি ছিল? শ্রীলঙ্কা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট হঠাৎ করে হয়নি। তাই শ্রীলঙ্কার কীভাবে বর্তমান সংকটে পতিত হয়েছে, তা বুঝতে হলে শ্রীলঙ্কার বর্তমান এবং অতীত সরকারের নেওয়া অর্থনৈতিক নীতিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণকালে মাহিন্দা রাজাপাকসে

২০০৫ ও ২০১৫ সালের মধ্যে যখন মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতায় ছিলেন এবং ২০১৯ সালের পর থেকে যখন রাজাপাকসে পরিবারের অন্য একজন সদস্য গোটাবায়া রাজাপক্ষে ক্ষমতায় আসেন, সে সময় তাদের গৃহীত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো দেখতে হবে। শ্রীলঙ্কা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর তাদের স্বল্পসুদে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে আসে। ফলে শ্রীলঙ্কাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজার থেকে উচ্চসুদ হারে ঋণ নিতে হয়। এই ঋণগুলোর মেয়াদও স্বল্পমেয়াদি (সাধারণত তিন থেকে ১০ বছর)। এই স্বল্পমেয়াদি উচ্চসুদ হারের ঋণটি পরবর্তীকালে শ্রীলঙ্কার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মাহিন্দা রাজাপাকসের আমলে সরকার বিদেশি ঋণ নিয়ে কয়েকটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ করেছিল, যেমন মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর এবং কলম্বো পোর্ট সিটি উন্নয়ন প্রকল্প। কিন্তু এই প্রকল্পগুলো প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে সরকারকে প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মিত সুযোগ-সুবিধা প্রায় অব্যবহূত রয়েছে। যার ফলে এ প্রকল্পটি একটি সাদা হস্তিতে পরিণত হয়েছে। বিনিয়োগের রিটার্ন পর্যাপ্ত না হওয়ায় সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা হ্রাস পায়। ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজার থেকে আরো উচ্চসুদে ঋণ নিতে হয়। যার ফলে বৈদেশিক ঋণের বোঝা আরো বেড়ে যায়। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার ঋণের বোঝা জিডিপির প্রায় ১০০ ভাগেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। অবশেষে, সরকার অন্য কোনো উপায় না পেয়ে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরটি একটি চীনা কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে বাধ্য হয়।

শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর – যাকে ধরা হয় উপমহাদেশের প্রবেশদ্বার

রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী ও স্হিতিশীল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হয়। কোভিড-১৯ শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পর্যটন শ্রীলঙ্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। কোভিডের ফলে পর্যটন খাতের রাজস্ব ২০১৯ সালের ৭.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২০ সালে ২.৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। কোভিড মহামারি এবং লক-ডাউনের কারণে অনেক কর্মজীবী মানুষ, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক এবং সেবা খাতে নিয়োজিত লোকজন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে কৃষি খাত তুলনামূলকভাবে সেবা খাতের তুলনায় অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই পর্যটন এবং অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক খাতের অনেক শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষি কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার জন্য গ্রামে চলে যায়। কিন্তু শ্রীলঙ্কা সরকার ঠিক এই সময়ে ১০০ শতাংশ অর্গানিক কৃষি চালু করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং অজৈব সার এবং কীটনাশক ওষুধ আমদানির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অজৈব সার এবং কীটনাশকের বিকল্প উৎস সরবরাহ না করে অজৈব সার এবং কৃত্রিম কীটনাশকের ওপর নিষেধাজ্ঞা শ্রীলঙ্কার কৃষিকে খুব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। চাল, শ্রীলঙ্কার একটি প্রধান খাদ্য এবং চা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী পণ্য। এই অর্গানিক কৃষিনীতির ফলে, চাল, চাসহ সবজি, ফল ও অন্যান্য কৃষি ফসলের উৎপাদন দারুণভাবে হ্রাস পায়। কোনো কোনো প্রতিবেদনে জানা যায় যে, কিছু ফসলের উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত কমে গেছে। উদ্ভূত পরিস্হিতে হতাশ হয়ে অনেক কৃষক কৃষিজমি চাষ না করে অনাবাদি রেখে দেয়। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী কৃষিজমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনাবাদি রয়ে যায়। এর ফলে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায় এবং দরিদ্র জনগণ খাদ্যনিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে। যদিও শ্রীলঙ্কা চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, খাদ্যোৎপাদনের ঘাটতির কারণে শ্রীলঙ্কাকে বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। যদিও, সার ও কীটনাশক নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ছিল আমদানি ব্যয় হ্রাস করা; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর আরো অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। কারণ খাদ্যোত্পাদন কমে যাওয়ায় সরকারের খাদ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যায় এবং চা উৎপাদন কমে যাওয়ায় চায়ের রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়

নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকার ২০১৯ সালে আরো একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকার আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর হ্রাস করে। যদিও এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করা, মহামারির সময়ে যখন সামাজিক কল্যাণের জন্য সরকারের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়, সেই সময়ে কর হার হ্রাস করায় সরকারের রাজস্ব আয় দারুণভাবে কমে যায়। এর ফলে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি আরো বেড়ে যায় এবং দেশের আর্থিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে।

বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের আগ পর্যন্ত রাজাপক্ষে পরিবারের পাঁচ সদস্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ গোটাবায়ার মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারের মধ্যে পারিবারিক আধিপত্যের কারণে সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বাধীন মতামত প্রকাশ এবং ভিন্নমত পোষণের সুযোগ সীমিত হয়ে আসে। পারিবারিক সিদ্ধান্তই অনেক ক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তে পরিণত হয়, যা পরবর্তীকালে বিরাট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়।

সঠিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ যে কোনো সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দেশের ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে সরকারি সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা ওপর থেকে কতিপয় ব্যক্তির মাধ্যমে নেওয়া হয়। অন্যদিকে, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা সরকারের বিভিন্ন স্তরে বণ্টন করা হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতা বরাদ্দ করা হয় এবং সরকারি সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় সরকারি নীতিমালার সম্ভাব্য সব পরিণাম সুফল ও কুফল বিচার বিশ্লেষণ করে যেটি জনগণের জন্য সর্বাধিক কল্যাণ বয়ে আনবে, সেটি গ্রহণ করা হয়।

শ্রীলঙ্কার এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যানের মতে, অর্থনৈতিক নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একটি পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত হলে তা দেশের জন্য অনেক বিপদ ডেকে আনতে পারে, যেমনটি এখন শ্রীলঙ্কায় ঘটেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সরকারের বিভিন্ন স্তরে অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বণ্টন করা উচিত।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান

দ্বিতীয়ত, সম্পদ দুষ্প্রাপ্য এবং তাদের বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। দুষ্প্রাপ্য সম্পদ এমনভাবে বিনিয়োগ করা উচিত, যাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উভয় ক্ষেত্রেই সমাজের সর্বোচ্চ কল্যাণ বয়ে আনে। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, এমন প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে বিনিয়োগ দেশের জন্য লাভের চেয়ে বেশি ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তাছাড়া বৈদেশিক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশকে বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারে।

তৃতীয়ত, সরকারি নীতিগত সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এবং বিশেষজ্ঞের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে গ্রহণ করা উচিত।

কোনো দেশে এক বছরে ১০০ শতাংশ অর্গানিক কৃষিব্যবস্থা প্রচলন করা সম্ভবপর নয়। কারণ এর জন্য কৃষক এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রস্তুত করতে এবং জৈবসার ও কীটনাশকের বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। সেজন্য বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রকল্প প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : তৈয়বুর রহমান, বিজনেস এডিটর, ডেইলিনিউজ২৪বিডি.কম

সুত্রঃ অর্থনীতি বিভাগ, আইইউবিএটি