গরমের জ্বালা মিটাতে প্রায়ই আমরা হুটহাট বাইরে তৈরি নানা ধরনের শরবত পান করি। এসব শরবত তৈরিতে যে সাদা বরফ ব্যবহার করা হয় তা শরীরের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সাদা বরফ স্মৃতিশক্তিকে ধীরগতি করে তোলে।
সাধারণত বরফ দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি বাণিজ্যিক এবং অন্যটি খাওয়ার বরফ। বিক্রেতারা শরবত তৈরির জন্য খাওয়ার উপযুক্ত বরফ ব্যবহার করে না। তারা এক্ষেত্রে ব্যবহার করে বাণিজ্যিক বরফ।
বাণিজ্যিক বরফ মূলত মাছ, মাংসের পাশাপাশি ওষুধ সংরক্ষণ, সিমেন্ট কারখানা, এমনকি মৃতদেহ সংরক্ষণেও ব্যবহৃত হয়। এসব বরফ মোটেও খাওয়ার উপযুক্ত নয়। স্বল্পমূল্যের কারণে বিক্রেতারা এ বরফ দিয়েই তৈরি করছে হরেক রকম পানীয়।
বাণিজ্যিক এই বরফগুলো পুকুর, ডোবা, নালার নোংরা পানি দিয়ে তৈরি করা হয়। যার কারণে এসব পানীয় শরীরে প্রবেশের পর পানিবাহিত রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
এই বরফগুলো বানানো হয় কারওয়ানবাজার, কাপতানবাজার, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ি এবং সোয়ারি ঘাটের বরফ কারখানায়। মাছের আড়ৎকে কেন্দ্র করেই গড়া ওঠেছে এই বরফ কারখানাগুলো। আসলে বরফকলে তৈরি এ বরফ মাছের জন্য বানানো হলেও অসাধু কিছু ব্যবসায়ী ভাসমান দোকান ও রেস্টুরেন্টে এই বরফ বিক্রি করে থাকেন। রাজধানীর ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে নামি-দামি ফার্স্টফুডের দোকানে অবাধে এ বরফ ব্যবহার করা হলেও দেখার কেউ নেই। অন্যদিকে এ বরফের শরবত পান করে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে মানুষজন। শুধু ফার্স্টফুডের রেস্টুরেন্টই নয়, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ও গাবতলীসহ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে ও লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় এবং এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, স্কুলের সামনে বেশি বিক্রি হয় এ বরফে তৈরি শরবত। অনেকেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আখের রস খেয়ে থাকেন। তবে রাস্তায় হকারদের বিক্রি করা আখের রসের বেশিরভাগেই ব্যবহৃত হয় নোংরা এই পানির বরফ।
আখের রসের মেশিনের ওপরই রাখা হয় বড় একটি বরফ খণ্ড। আবার বরফ খল্ড খোলা থাকায় তার ওপর ধুলা ময়লা জমে। এটি না ধুয়ে আখ ভাঙিয়ে রস বিক্রি করা হয়। বরফ গলা ঠাণ্ডা পানি আখের রসের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। নিউমার্কেটের বনলতা এলাকায় বরফ তৈরি করা হয়। সেখানকার একজনের কাছে জানতে চাওয়া হয় এ বরফ কোথায় যাবে? তিনি বলেন, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন ভাসমান ও ফার্স্টফুডের দোকানে। তবে এ বরফ পরিষ্কার পানিতে তৈরি কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন,আমি জানি না। কাওরানবাজার, কাপতানবাজার, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী,সোয়ারিঘাট ও এলাকায় মাছের আড়তকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বরফ কারখানা। এসব কারখানা থেকেই বরফ চলে যায় রাজধানীর ফার্স্টফুডের দোকানগুলোসহ ফুটপাতের শরবতের দোকান গুলোতে।
সেই বরফেই মজাদার ,সুস্বাধু লাচ্ছি ও শরবত তৈরি হয়। নীলক্ষেত, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী এলাকার কয়েকজন বরফকল শ্রমিক কাজী জানান, সাধারণত ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানিতে তৈরি করা হয় এ বরফ। এসব বরফ মূলত মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্যই তৈরি করা হয়। এ বরফ শরবত ও রেস্টুরেন্ট দোকানিরা কিনে নিয়ে শরবত বানান। তবে রেস্টুরেন্ট বা ফার্স্টফুডের দোকানগুলোর জন্য অর্ডারে আলাদাভাবে কোনো ধরনের বরফ বানানো হয় না। রাজধানীর বঙ্গমার্কেটে ভ্যানে করে বরফ সাপ্লাই দেন রায়হান চৌকিদার। তিনি বলেন,কারখানায় অর্ডার করলে বরফ দিয়ে যাই। এছাড়া বিভিন্ন শরবত ও রেস্টুরেন্ট দোকানেও দেয়া হয়। সব বরফ একই, শরবত ও রেস্টুরেন্ট দোকান জন্য আলাদা করে বানানো হয় না।
এই বিষয় বরফ মালিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, শুধু মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বরফ বিক্রি করি, সেটি অন্য কাজে ব্যবহৃত হলে এর জন্য তো আমরা দায়ী নয়। জানা গেছে, বাসার ফ্রিজে বরফ তৈরি করলে কারখানার মতো এতো সাদা হয় না। কারখানার বরফে ট্যালকম পাউডার দিয়ে সাদা করা হয়। এতে করে বরফ সাদা এবং শক্ত হয়। সদরঘাটে আখের রস বিক্রেতা বাবুল মিয়া ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, রোদের সময় বরফ দিয়ে আখের রস বিক্রি করলে বেশি চলে। বরফ না থাকলে অনেকে রস খায় না। গুলিস্তান লেবুর শরবত বিক্রিতা সাব্বির ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, আমরা অর্ডার করলে কারখানা থেকে বরফ দিয়ে যায়। কোন পানি দিয়ে বরফ বানায় তা জানি না। বরফ ছাড়া লেবুর শরবত চলে না। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা মনে করেন, ফুটপাথের বানানো এ শরবত পানে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।
কেউ রাস্তার এই শরবত পান করলে কিডনিজনিত সমস্যা, পানিবাহিত রোগ, গ্যাস্ট্রিক, হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস, লিভারের জটিলতা, পাকস্থলীতে প্রদাহ, খাদ্যনালিতে সমস্যা ও পেপটিক আলসারসহ মারাত্মক জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। মাছ বাজারের বরফ কারখানায় দেখা যায় নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে বরফ। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে খালি গায়ে শ্রমিকরা এই বরফ তৈরির কাজ করছে। সরাসরি নোংরা পানি দিয়ে এই বরফ তৈরি করা হচ্ছে। যারা এই বরফ তৈরির সঙ্গে জড়িত, তাদের পোশাকও পরিচ্ছন্ন নয়। আবার বরফ তৈরি হয়ে গেলে তা চট বিছিয়ে ফ্লোরেই রাখা হচ্ছে। ওই ফ্লোরেই আবার জুতা-স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে সবাই ঘোরাঘুরি করছে।
বাণিজ্যিক বরফের ব্যবহার প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস বলছেন, বাণিজ্যিক বরফে ধাতব পদার্থের পাশাপাশি বিসফেনল মিশে থাকে। এ কারণে এই বরফ মেশানো পানীয়, শরবত বা শুধু পানি পান করলে মনের রাখার ক্ষমতা কমে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ বিসফেনল থাইরয়েড গ্রন্থির স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। যার প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কে। শিশুদের ক্ষেত্রে মেমরি ডেভেলপমেন্টে এই রাসায়নিক পদার্থ বাঁধা সৃষ্টি করে।
বিসফেনল ছাড়াও এই সাদা রঙের বড় বড় বাণিজ্যিক বরফে রয়েছে ভারী ধাতু, পানি বাহিত রোগের বীজ এবং বিভিন্ন ধরনের দূষক। তাই এই বরফ শরীরে ঢুকলে স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে পেটের রোগ যেমন হয়, তেমনই দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি তা ক্যানসারের কারণও হতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।