প্রচলিত অপরাধের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাইবার অপরাধ বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাইবার অপরাধীরা নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে এমন অপরাধ করে যাচ্ছেন। কখনও ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা সেজে, কখনও বা ফেসবুক আইডি হ্যাক করে, আবার কখনও স্পর্শকাতর ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলছে সাইবার অপরাধ।
শুধু হুমকি নয়, গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় উস্কানি দেওয়ার মাধ্যমে সাধারণের যৌক্তিক আন্দোলন ভিন্ন খাতে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এরপরও সাইবার অপরাধীদের ঠেকাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গেল বছর (২০২১ সাল) সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন মোট ৯৬৩ জন। এর মধ্যে ৪৮০ জন নারী ও ৪৮৩ জন পুরুষ। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৮ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে, ৩১ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে, ৩৪ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, ২৩ শতাংশের বয়স ৩৬ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে এবং চার শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের ওপরে।
সিটিটিসির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সূত্রে জানা যায়, আগে একটি সময় ছিল কোনো ব্যক্তি সিম তুলতে গেলে কৌশলে তার আঙুলের ছাপ রেখে দিতেন দোকানিরা। পরে ওই ব্যক্তি যাওয়ার পর তার আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে একাধিক সিম তুলে নিতেন তারা। পরে এসব সিম অপরাধীরা বাড়তি টাকা দিয়ে কিনে নিতেন। কিন্তু এখন একটি সিম তোলার তিন ঘণ্টা পর আরেকটি সিম তোলার নিয়ম হয়েছে ।
ওই তালিকা অনুযায়ী, অপরাধের ১৯ শতাংশ ফেসবুক আইডি হ্যাকজনিত, এক শতাংশ ই-মেইল আইডি হ্যাকজনিত, ১৫ শতাংশ ফেক (ভুয়া) আইডি সংক্রান্ত, ১৫ শতাংশ সেক্সটরশন সংক্রান্ত, ২২ শতাংশ মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত এবং ২৮ শতাংশ অন্যান্য হ্যারাজমেন্ট সংক্রান্ত সাইবার অপরাধ।
অন্যদিকে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের গত বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোট ২০৬টি সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে। এর মধ্যে ফেসবুক আইডি হ্যাক সংক্রান্ত ১৭টি, অনলাইন হ্যারাজমেন্ট ৩৭টি, মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত ৫১টি, অনলাইন প্রোডাক্ট পারচেজ সংক্রান্ত প্রতারণার অভিযোগ চারটি, পার্সেল ফ্রড সংক্রান্ত পাঁচটি, অনলাইন ব্ল্যাক-মেইলিং সংক্রান্ত দুটি, অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগ সংক্রান্ত ২৭টি, পর্নোগ্রাফি ধারণ ও প্রচার সংক্রান্ত ২৪টি, ধর্মীয় উস্কানিমূলক প্রচারণা সংক্রান্ত সাতটি এবং অন্যান্য ৩২টি অভিযোগ আসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অল্পকিছু কৌশল খাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ধুলা দিতে সক্ষম হচ্ছেন সাইবার অপরাধীরা। কৌশলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভুয়া সিম কার্ড ব্যবহার।
অনলাইন প্রতারকদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় ভুয়া সিমের জন্য। আমাদের কাছে আসা সাইবার অভিযোগের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামির সিম থাকে
ভুয়াধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ, ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সহকারী কমিশনার
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সাইবার অপরাধের মামলার আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভুয়া সিম (অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম)। সাইবার অপরাধীরা যখন বুঝতে পারে তারা দ্রুত শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হয়ে যাবে, তখনই ভুয়া সিম বন্ধ করে ফেলে। ফেসবুকে পুলিশ, আর্মিসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করা প্রতারকরা সবচেয়ে বেশি ভুয়া সিম ব্যবহার করে।
যেহেতু অধিকাংশ সাইবার অপরাধীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডিগুলো ভুয়া থাকে, তাই তাদের ব্যবহার করা ফোন নম্বরটি হলো একমাত্র শনাক্তের পথ। কিন্তু ফোন নম্বরটির রেজিস্ট্রেশন যখন ভুয়া থাকে তখন তাদের ট্রেস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এসব অপরাধীকে শনাক্ত করতে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে হয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিতে হয় অনেকটা সময়।
যে কারণে বাড়ছে ভুয়া সিমের ব্যবহার
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার সূত্রে জানা যায়, একই সময়ে সাইবার অপরাধীদের ফেসবুকে অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট চালু থাকে। এসব অ্যাকাউন্ট চালানোর জন্য যে স্মার্ট ফোনটি ব্যবহার করা হয় তাতে প্রতারকদের নামে নিবন্ধিত সিম কার্ড ব্যবহার করা হয় না। আর গ্রেপ্তার বা আটকের আশঙ্কা দেখা দিলে প্রতারকরা অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা থেকে শুরু করে মোবাইল নম্বরও পরিবর্তন করে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে তারা মোবাইলের আইএমইআই নম্বরও পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে ট্রেসলেস (চিহ্নিত করা যায় না) হয়ে পড়ে প্রতারকরা। তাদের আইনের আওতায় আনতে বেশ বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
সম্প্রতি সিআইডির এক কর্মকর্তা রাজধানীর স্বনামধন্য একটি কলেজের শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়া এক প্রতারক নারীর সন্ধান পান। যে কি না বিভিন্নজনের ম্যাসেঞ্জারে অন্য নারীদের নগ্ন ছবি ও ভিডিও নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে এক/দুই হাজার টাকা হাতিয়ে নিতেন। পরে সিআইডির ওই কর্মকর্তা খোঁজ নিয়ে দেখেন, ওই নারী রাজধানীর স্বনামধন্য একটি কলেজের শিক্ষার্থী বলে যে পরিচয় দিয়েছিলেন তা আসলে ভুয়া। এছাড়া ওই নারীর ব্যবহার করা দুটি নম্বরও ছিল ভুয়া। ফলে শেষ পর্যন্ত তদন্ত করে ওই প্রতারক নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি।
কখনও ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা সেজে, কখনও বা ফেসবুক আইডি হ্যাক করে, আবার কখনও স্পর্শকাতর ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলছে সাইবার অপরাধ
ভুয়া সিম যেভাবে পাচ্ছেন অপরাধীরা
সিটিটিসির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সূত্রে জানা যায়, আগে একটি সময় ছিল কোনো ব্যক্তি সিম তুলতে গেলে কৌশলে তার আঙুলের ছাপ রেখে দিতেন দোকানিরা। পরে ওই ব্যক্তি যাওয়ার পর তার আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে একাধিক সিম তুলে নিতেন তারা। পরে এসব সিম অপরাধীরা বাড়তি টাকা দিয়ে কিনে নিতেন। কিন্তু এখন একটি সিম তোলার তিন ঘণ্টা পর আরেকটি সিম তোলার নিয়ম হয়েছে। সাধারণ দোকানিরাও দীর্ঘক্ষণ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করতে পারেন না। তবে এখন সেই পদ্ধতি না থাকায় তিন ধাপে অপরাধীদের কাছে যাচ্ছে ভুয়া সিম।
জানা যায়, ভুয়া সিম তৈরির চক্রগুলো তিন ধাপে কাজ করে। তারা প্রথমে গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের ২০০-৫০০ টাকা দিয়ে তাদের আঙুলের ছাপ নিয়ে নতুন সিম তোলেন। আবার অনেকে টাকার জন্য নতুন সিম তুলে এসব চক্রের কাছে হাজার টাকায় বিক্রি করেন। তৃতীয় ধাপে ওই সব দালালের কাছ থেকে সাইবার অপরাধীরা দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় সিমগুলো সংগ্রহ করেন।
সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন জানায়, দেশে এমন একাধিক সিম বিক্রি করার চক্র কাজ করছে। গ্রেপ্তার ও ধরা পড়ার ভয়ে চক্রগুলো ঢাকায় সক্রিয় নয়। তারা ঢাকার বাইরে এসব সিম ক্রয়-বিক্রয় করছে। আবার কিছু প্রতারক আছে যারা গ্রামে গ্রামে মেশিন নিয়ে ঘোরে। নানা প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের কাছ থেকে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে সিম তুলে ফেলে।
গেল বছর (২০২১ সাল) সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন মোট ৯৬৩ জন। এর মধ্যে ৪৮০ জন নারী ও ৪৮৩ জন পুরুষ। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৮ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে, ৩১ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে, ৩৪ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, ২৩ শতাংশের বয়স ৩৬ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে এবং চার শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের ওপরে।
ভুয়া সিমের কারণে যে সমস্যায় পড়ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এক নারী বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। অফিসের পেনড্রাইভে ওই নারীর দুটি গোপন ভিডিও এবং কিছু নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি ছিল। অফিস থেকে পেনড্রাইভটি সবুজ নামের এক ব্যক্তির কাছে কীভাবে চলে যায়, তা ওই নারী জানতেন না। গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সবুজ ওই নারীকে ফোন দিয়ে বলেন, আপনার কিছু গোপন ভিডিও ও ছবি আমার কাছে আছে। পেনড্রাইভসহ সেগুলো ফেরত পেতে হলে আমার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলে কথা বলতে হবে। বাধ্য হয়ে ওই নারী সবুজের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন। একপর্যায়ে ভিডিও কলে সবুজ আপত্তিকর কিছু দাবি উপস্থাপন করেন। ওই নারী রাজি না হওয়ায় সবুজ ভিকটিমের ভিডিও ও আপত্তিকর ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
ওই নারী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে বান্ধবীর পরামর্শে ভিকটিম মোহাম্মদপুর থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের ইন্টারনেট রেফারেল টিম।
মামলার তদন্তে দেখা যায়, অভিযুক্ত যে ফোন নম্বরটি ব্যবহার করে ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলতেন তা আসলে ভুয়া সিম অর্থাৎ অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। কোনো না কোনোভাবে মামলা হওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে সবুজ সিমটি বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে প্রায় ট্রেসলেস হয়ে পড়েন তিনি। এদিকে, ভিকটিমও চিন্তিত হয়ে পড়েন, সবুজ যদি তার ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। পরে নানা গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে সবুজকে গত বছরের শেষ দিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
.সবুজ জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, অন্যের নামে সিমটি সে টাঙ্গাইলের এক দোকানির কাছ থেকে কেনে।
সম্প্রতি এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
সাইবার অপরাধের মামলার আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভুয়া সিম (অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম)। সাইবার অপরাধীরা যখন বুঝতে পারে তারা দ্রুত শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হয়ে যাবে, তখনই ভুয়া সিম বন্ধ করে ফেলে। ফেসবুকে পুলিশ, আর্মিসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করা প্রতারকরা সবচেয়ে বেশি ভুয়া সিম ব্যবহার করে
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইন্টারনেট রেফারেল টিমের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আফছর আহমেদ বলেন, সাইবার ক্রাইমের অধিকাংশ মামলার ক্ষেত্রে আমরা দেখি আসামিরা ভুয়া ফেসবুক আইডি ব্যবহার করেন। প্রতারণা বা অপরাধ শেষে তারা ওই আইডি বন্ধ করে দেন। তখন আমরা খুঁজে দেখি আসামির কোনো ফোন নম্বর আছে কি না। ফোন নম্বর পাওয়ার পর যখন আমরা দেখি সেটি অন্যের নামের রেজিস্ট্রেশন করা, তখন আসামিকে শনাক্ত করা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ সময় পার হলেও আসামিকে ট্রেস করা যায় না। পরে আমরা বিভিন্নভাবে গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসামিকে শনাক্ত করি। এতে আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয়।
কোন ফোনে ভুয়া সিমের ব্যবহার বেশি
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ভুয়া সিম আসলে যেকোনো মোবাইল ফোনে ব্যবহার করেন প্রতারকরা। বিকাশ প্রতারণার ক্ষেত্রে অপরাধীরা আইফোনে ভুয়া সিম ব্যবহার করেন বেশি। উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্যরা বাটন ফোনে এসব সিম ব্যবহার করেন। যাতে তাদের সহজে শনাক্ত করা না যায়। সাইবার অপরাধীরা অধিকাংশ সময় স্মার্ট ফোনে ভুয়া সিম ব্যবহার করে থাকেন।
ভুয়া সিমের বিষয়ে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সহকারী কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ বলেন, অনলাইন প্রতারকদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় ভুয়া সিমের জন্য। আমাদের কাছে আসা সাইবার অভিযোগের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামির সিম থাকে ভুয়া।
‘তবে, এখন সেই অর্থ ভুয়া সিম বিক্রি করার সুযোগ নেই। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, একজনের নামের সিম অন্য জন্য ব্যবহার করছেন। এ ধরনের ঘটনা অহরহ দেখা যাচ্ছে। ফলে প্রতারকদের ধরা বেশ কষ্টকর হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ভুয়া সিমের চক্রগুলো কয়েক ধাপে কাজ করে। কিছু লোক ভুয়া সিম ক্রিয়েট (তৈরি) করে, আবার কিছু লোক তা কালেক্ট (সংগ্রহ) করে। সর্বশেষ কিছু লোক ভুয়া সিম অপরাধীদের কাছে বিক্রি করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, টাকার বিনিময়ে অন্য লোকের আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে সিম তোলা হয়। পরে সেই সিম অপরাধীদের হাতে পৌঁছে যায়।
ভুয়া সিমের বদৌলতে বেপরোয়া প্রতারকরা
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রথমে পুলিশ, র্যাব, আর্মিসহ সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিসের কর্মকর্তাদের ফেসবুক আইডি দীর্ঘদিন ধরে ফলো করে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তাদের পদবি সংগ্রহ করে। পরে এসব কর্মকর্তাদের আইডির আদলে নিজেদের ফেসবুকের আইডি তৈরি করে। আইডির প্রোফাইলের ছবিও অধিকাংশ সময় ভুয়া থাকে। ভুয়া পরিচয়ে তারা মানুষের কাছে বিভিন্ন কায়দায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বিশ্বাসী হয়ে ওঠার পর কাউকে তদবিরের কথা বলে, আবার কাউকে বিয়ের কথা বলে প্রতারণা করে তারা। আর ধারা পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ভুয়া সিম বন্ধ করে ট্রেসলেস হয়ে যাচ্ছে প্রতারকরা।
আমাদের কাছে প্রায় প্রতি মাসেই এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ আসে। শত শত ভুয়া ফেসবুক আইডি ব্যবহার করা হচ্ছে। কখনও উপ-সচিব, কখনও পুলিশ কিংবা আর্মির অফিসার পরিচয়ে তারা প্রতারণা করে যাচ্ছে। নানা কারণে পুলিশের কাছে এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে খুব কম ভুক্তভোগীই আসছেন। ফলে প্রতারকদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে
মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ, সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার
উদ্দেশ্য শারীরিক সম্পর্ক ও অর্থ আত্মসাৎ
নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, ফেসবুকে ভুয়া পরিচয় দিয়ে যারা প্রতারণা করেন তাদের অধিকাংশের উদ্দেশ্য হলো ব্ল্যাকমেইলিং করে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং অর্থ আত্মসাৎ করা। এক্ষেত্রে নারীরা শারীরিক সম্পর্ক আর পুরুষরা বেশি শিকার হন অর্থ আত্মসাতের প্রতারণায়।
মন্ত্রীর নামেও প্রতারণা
সম্প্রতি সিআইডির এক কর্মকর্তাকে ভুক্তভোগী এক নারী বলেন, তার সঙ্গে ফেসবুকে এক মন্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই মন্ত্রী মাঝেমধ্যে ওই নারীর সঙ্গে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথা বলতেন। এভাবে মন্ত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন। তার কাছে সন্দেহজনক মনে হলে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি বিষয়টি জানান। সিআইডির কর্মকর্তা ওই নারীকে মন্ত্রীর পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে কৌশলে তার নম্বর জেনে তাকে জানাতে বলেন। সেই মতো ওই নারী মন্ত্রীর নম্বর কৌশলে জেনে সিআইডির কর্মকর্তাকে দেন। পরে ওই নম্বর ও মন্ত্রীর পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির ফেসবুক আইডি তদন্ত করে দেখা যায়, নম্বরটি নির্দিষ্ট একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর হলেও ফেসবুকে মন্ত্রী পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিটি ভুয়া। তিনি নিজেকে মন্ত্রী পরিচয় দিয়ে নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। আর তার পরিচয় নিয়ে কেউ সন্দিহান হলে আসল মন্ত্রীর নম্বর দিয়ে আইডি ব্লক করে দিতেন। ফলে তার সঠিক নম্বর ও পরিচয় না থাকায় পুলিশও তাকে ট্রেস করতে পারেনি।
অনলাইনে ভুয়া পরিচয় দেওয়ার বিষয়ে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বলেন, আমাদের কাছে প্রায় প্রতি মাসেই এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ আসে। শত শত ভুয়া ফেসবুক আইডি ব্যবহার করা হচ্ছে। কখনও উপ-সচিব, কখনও পুলিশ কিংবা আর্মির অফিসার পরিচয়ে তারা প্রতারণা করে যাচ্ছে। নানা কারণে পুলিশের কাছে এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে খুব কম ভুক্তভোগীই আসছেন। ফলে প্রতারকদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।
এছাড়া অভিযোগ পেলেও সবসময় তাদের ধরা যাচ্ছে না। প্রতারকদের মধ্যে যারা প্রফেশনাল তারা কখনও নিজের ফোন নম্বর ভুক্তভোগীর সঙ্গে শেয়ার করেন না। যারা নম্বর দিচ্ছে তা আবার অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। ফলে তাদের ট্রেস করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তারপরও আমাদের তৎপরতায় অনেক প্রতারক ধরা পড়ছেন।