বিবিসি নিউজ বাংলার ২০২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রচারিত এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অফিসে রেখে গিয়েছিল ১৮ ডলার। এ অবস্থায় ভারত বিরাট সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। সুইডেন ও কানাডা সোনাও দিয়েছিল, ডলারও দিয়েছিল। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রথম যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তা ছিল চরম নেতিবাচক।
এতে বলা হয়, ৮০ ভাগ মানুষ কৃষি কাজে নিয়োজিত। একজন কৃষকের গড়পড়তা জমি দেড় একর, তার আছে একটি রুগ্ন গরু, যা দিয়ে হাল চাষ হয়। উৎসব বা সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে চড়া সুদে ধার করতে হয়। জনসন নামে একজন আমেরিকান কূটনীতিক অভিমত প্রকাশ করেন, বাংলাদেশ বেশিদিন টিকবে না। এটা হবে ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি জাস্ট ফালেন এবং তার একজন সহযোগী লিখেছিলেন, বাংলাদেশের ভূগোল ঠিক আছে, অর্থনীতি ঠিক নেই। এই দেশের অর্থনীতি টেকসই করতে দুশ’ বছর সময় লাগবে। ১৮ ডলার রিজার্ভ নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন আমরা বাস্কেট কেস নই।
কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন শেষ হতে না হতেই বাংলাদেশ নতুন সংকটে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক ২৬ অক্টোবর কমোডিটি মার্কেট আউটলুকে বলেছে, বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রার দরপতন ঘটেছে, খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়েছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। রেকর্ড উচ্চ মূল্যের কারণে জ্বালানির মধ্যে তরল জ্বালানি পাওয়া যাচ্ছে না। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তা ইউরোপের দেশগুলো চড়া দামে কিনে নিচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ অনেক দেশ উচ্চ মূল্য দিয়ে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছে না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য এবং স্থানীয় মুদ্রার দরপতনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেগুলোতে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে।
অথচ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম ২৭ অক্টোবর জাতীয়তাবাদী যুবদলের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের টাকা শেখ হাসিনার সরকার গিলে ফেলেছে।’ [প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর, ২০২২] গণমাধ্যমে ফ্যাক্ট চেকিং হওয়া উচিত বলেই অনেকে মনে করেন। কোনো রাজনৈতিক নেতা বা অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবি করা কেউ কিছু বললেই তা সংবাদপত্রে প্রকাশ বা টেলিভিশনে প্রচার করতে হবে? অসৎ উদ্দেশ্য বা বদ মতলবে কেউ কিছু বললেই তা প্রচার করে দিতে হবে?
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল করোনা। এর প্রভাবে বেশিরভাগ দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। উৎপাদন ব্যাহত হয়। স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করতে হয়। বাংলাদেশ করোনার মধ্যেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মোটামুটি সচল রাখার জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিও ছিল। করোনার কারণে ঢাকার রাজপথে হাজার হাজার মানুষের মরদেহ পড়বে-এমন প্রচার করা হয়েছিল একটি মহল থেকে। আরও বলা হয়েছিল- পোশাক শিল্পে ধস নামবে, বিভিন্ন দেশে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত আসবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসবে। বাস্তবে এমনটি ঘটেনি।
বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখন খাদ্য মূল্য বৃদ্ধির কারণে কষ্টে আছে। বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, শিক্ষা এবং আরও অনেক খাতে ব্যয় বেড়েছে। বাংলাদেশ যখন ধান ও শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে, আম ও আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম স্থানে, অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে প্রথম স্থানে, তখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক ঠিকভাবে খেতে না পারা নিদারুণ উদ্বেগের। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির সব দায় বাংলাদেশের নয়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে অসাধু একটি মহল কারসাজি করে খাদ্যসহ অনেক ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে- এটাও অস্বীকার করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, ১. ‘বাংলাদেশে আজ তিনটি মহাবিপদ, মুদ্রাস্ফীতি, যা আজ বিশ্বে ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে, ২. প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যা, এবং ৩. চোরাকারবারি, মুনাফাবাজ, মজুতদারও ঘুষখোর’।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় তিনি খাদ্য উৎপাদন ডাবল করার আবেদন জানিয়েছিলেন। যদি ডাবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাব ইনশাল্লাহ হবে না। ভিক্ষুকের মতো কারও কাছে হাত পাততে হবে না।
১৭ অক্টোবর (২০২২) বিশ্বখাদ্য দিবস উপলক্ষে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্বে যে মহামন্দা ধেয়ে আসছে তাতে বাংলাদেশে যেন খাদ্যের অভাব দেখা না যায় সেজন্য সবাইকে উৎপাদন বাড়াতে হবে। যার যা জমি আছে উৎপাদন করতে হবে। উৎপাদনে মনোযোগী হন, সাশ্রয়ী হন। আমাদের অনেক জায়গা আছে। সরকারি অফিস, বিভিন্ন স্কুলে জায়গা আছে। বিভিন্ন জায়গায় যে যা পারেন বিভিন্ন সবজি উৎপাদন করেন।
অনেকে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানে ভুল কিছু রয়েছে কি? বাংলাদেশের সক্ষমতার মহাপ্রকল্প হচ্ছে পদ্মা সেতু। কিন্তু এক সময় বিশ্বব্যাংক এটা চায়নি। তারা বদনাম দিয়েছে। অন্যদিকে ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া বলেছিলেন, শেখ হাসিনার সরকার পদ্মা সেতু করতে পারল না। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি সেতুর কাজ অনেকটা শেষ হওয়ার পর তিনি বলেন, পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। আর যদি সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানায়, কেউ সেতুতে উঠতে যাবেন না। অনেক রিক্স আছে।
এ বছর ২৫ জুন সেতু উদ্বোধনের পর এক দুর্বৃত্ত সেতুর রেলিংয়ের হাজার হাজার নাট-বল্টুর মধ্য থেকে সবার অলক্ষ্যে একটি খুলে তার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দিলে কিছু লোক বলতে শুরু করল, খালেদা জিয়া তো ঠিকই বলেছিলেন। সেতু উদ্বোধনের আগে ও পরে একটি অসাধু মহল বলতে শুরু করে, অনেক কম খরচে এ সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল। এমনকি যে মহল সর্বক্ষণ ভারতের বদনাম করে, তারাও বলতে থাকে, আসামের ভুপেন হাজারিকা সেতু অনেক কম ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ব্যয় বেশি দেখিয়ে বাকি টাকা গিলে খেয়েছে। খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলেছেন, নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ আত্মঘাতী পদক্ষেপ। সেতুর টোল নিয়েও অপপ্রচার কম হয়নি।
মাত্র চার মাসেই পদ্মা সেতু নিয়ে যাবতীয় অপপ্রচার ভুল প্রমাণ হয়েছে। এ সেতু ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নিরাপদ খেয়া, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। যে খাদ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত উদ্বেগ, তা কমিয়ে আনতেও পদ্মা সেতু অবদান রাখতে পারবে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হবে এ সেতু।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এখন উচ্চফলনশীল জাতের শস্য ও অন্য ফসল চাষ হয়। এ জন্য সেচের পানি চাই, সেচযন্ত্র চালাতে ডিজেল বা বিদ্যুৎ চাই। সার ও কীটনাশক চাই। এর সব কিছু বাংলাদেশে মিলে না। সঙ্গত কারণেই সমস্যা প্রকট। বিপদে পড়লে চামচিকাও হাতিকে লাথি মারতে চায়, এটা প্রবাদ।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের চড়া দামের সময় একটি মহল সব দোষ শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। এ সব মোকাবিলা অপেক্ষাকৃত সহজে করার জন্য সরকারের সব ধরনের কাজে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা থাকা চাই। দুর্নীতি-অনিয়ম সর্বনিম্ন পর্যায়ে কমিয়ে আনার প্রতিও নজর দিতে হবে। ১৯৭৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম রাতারাতি বেড়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের চলাচলের জন্য ছোট গাড়ি ব্যবহার শুরু করেন। করোনার সময় থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। এতে সরকারের ব্যয় কমে। কিন্তু সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের সবাই কি এমন পথে চলতে ইচ্ছুক?
ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা জ্বালানির উচ্চ মূল্য, পরিবহন ব্যয়, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এ সব কারণ দেখিয়ে তাদের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলছেন এবং সরকারের কাছে চাইছেন নানা সুবিধা। কিন্তু তারা কি নিজেদের প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে ফেলায় উদ্যোগী হয়েছেন? তারা কি দামি গাড়ির ব্যবহার কমাতে ইচ্ছুক? বিদেশ সফরও কি কমেছে? অর্থ পাচার কি কমেছে?খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষকদের সব ধরনের সুবিধা দিতেই হবে। উপকরণ মূল্য যতটা সম্ভব কম রাখতে হবে। কৃষি ঋণের সুদ কমাতে হবে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ সার-বিদ্যুৎ ও অন্য খাতে ভর্তুকির বিরুদ্ধে।
এ চাপ মোকাবিলা করতে হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক পর্যায়ে জাতীয় সমঝোতা চাই। বাংলাদেশে কি সেটা আদৌ সম্ভব? বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ এনে বাংলাদেশকে বদনাম দিতে শুরু করলে তখন আমাদেরই একটি মহল তাদের বাহবা দিতে থাকে। শেখ হাসিনা খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো এবং সর্বক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়ার যে অনুরোধ জানাচ্ছেন তাতে কি এ মহল থেকে বাগড়া দেয়া হবে? তারা কি এটা চাইবে, খাদ্য ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন বিঘ্নিত হোক, দেশের মানুষ কষ্ট পাক? বহু বছর বাংলাদেশ খাদ্যে পরনির্ভর ছিল। এখন প্রচুর গম আমদানি করতে হয়। প্রয়োজনীয় চালের প্রায় সবটা নিজেরা উৎপাদন করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, খাদ্য ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন বাড়াতে পারলে বাংলাদেশ তা রফতানি করতে পারবে। বাংলাদেশ কি এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে? খাদ্যে বাংলাদেশ যখন প্রবলভাবে পরনির্ভর ছিল তখন যুক্তরাষ্ট্র সে সুযোগ নিয়ে খাদ্য-রাজনীতি করেছে। বাংলাদেশকে বাধ্য করেছে সাহায্যের বিনিময়ে অন্যায় শর্ত মেনে নিতে। আবার কি সেই অন্ধকার যুগে, খাদ্য-রাজনীতির ফাঁদে বাংলাদেশ ফিরে যাবে?
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার বেআইনি ।
2023 DailyNews24BD.com