সূর্যোদয়ের দেশ নিপ্পন বা জাপান। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে পর্বতবেষ্টিত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত দ্বীপরাষ্ট্র জাপান এশিয়ার সমৃদ্ধিশালী ও অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় একটি দেশ।
জাপানের সমৃদ্ধির যাত্রা শুরু হয় ১৮ শতকের মেইজি বিপ্লবের সময় জ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনরায় সমৃদ্ধ করতে মূল চালিকাশক্তি ছিল এ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মঠ তরুণ সমাজ। তবে বিগত দুই দশক জাপানের জনসংখ্যার পাশাপাশি কমছে তাদের তরুণ সমাজ, যারা মূলত বহন করে ক্রমবর্ধমান বয়স্ক নাগরিকদের চিকিৎসা ও পেনশন ভাতার বোঝা। উন্নত জীবনের জন্য অতিরিক্ত কাজ, একাকিত্ব জীবন, বিয়ে না করা, বিয়ে করলেও সন্তান জন্ম না দেয়া এবং যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ততা জাপানের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। কিন্তু জাপানিজরা খুবই রক্ষণশীল জাতি, তারা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং জাতিগত একতা ধরে রাখতে চায় আর এজন্য বিদেশী নাগরিকদের জাপানে প্রবেশ এবং বসবাস করায় অনেক কঠোরতা অবলম্বন করে।
তবে দেশের বিভিন্ন খাতে দক্ষ কর্মীর অভাবে সাম্প্রতিক কালে জাপান তাদের কঠোরতা কিছুটা শিথিল করেছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই জাপান সরকার ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে নতুন অভিবাসী আইনের আওতায় পাঁচ লাখ নতুন অভিবাসীকে স্বাগত জানাচ্ছে। বর্তমানে জাপানে ২ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন অভিবাসী রয়েছে, যা তাদের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৯ শতাংশ। তাদের মধ্যে ১ দশমিক ২৮ মিলিয়ন বিভিন্ন পেশাতে কর্মরত (barta24.com, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮)। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) গবেষণা শাখা জানিয়েছে, বর্তমানে বিদেশী কর্মীরা জাপানের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ (bonikbarta.net, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।
নিম্ন জন্মহারের কারণে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি শ্রম ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোরও উদ্যোগ নিয়েছে জাপান, এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দেশটিকে বিদেশী কর্মীর সংখ্যা চার গুণ বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছে টোকিওভিত্তিক একটি পাবলিক থিংক ট্যাংক। জাইকার গবেষণা শাখা মতে জাপানের দীর্ঘমেয়াদে গড় বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৪ শতাংশ ধরে রাখতে হলে সরকারকে ২০৪০ সালের মধ্যে বিদেশী কর্মীর সংখ্যা ৬৭ লাখ ৪০ হাজারে উন্নীত করতে হবে, যা বর্তমান কর্মী সংখ্যার ৩০০ গুণ (bonikbarta.net, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। অর্থাৎ জাপানের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনে অন্য দেশের জনশক্তির ওপর নির্ভরতা আরো বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশ এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে, তবে এজন্য প্রয়োজন জাপানের চাহিদা অনুযায়ী জাপানি ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন এবং তাদের সংস্কৃতি ও কার্যপদ্ধতি অনুযায়ী দক্ষ জনবল প্রস্তুত করা।
জাপান একটি শিল্পোন্নত দেশ যার মূলে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্পনেতা, কারিগর, সুশিক্ষিত ও পরিশ্রমী কর্মী বাহিনী, উচ্চমাত্রায় সঞ্চয়ের প্রবণতা, উচ্চ বিনিয়োগ হার, শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্য উন্নয়নের জন্য সরকারের জোরালো সমর্থন। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিগুলো ১৯৯০-এর দশকে এসে ‘বাবল ইকোনমি’র প্রভাবে নাটকীয়ভাবে ধীর হয়ে পড়ে এবং ২০০০ সালের পর আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ খুব কম হলেও বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে জাপান যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, তা অর্থনীতির জন্য কাঁচামাল ক্রয়ে ব্যবহার করা হয়। জাপানের মাত্র ১৫ শতাংশ ভূমি আবাদযোগ্য যা ব্যবহার করে কৃষিতে তারা প্রায় ৪০ শতাংশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ধানের উৎপাদন দেশের চাহিদা মিটিয়ে খানিকটা উদ্বৃত্ত থাকলেও গম, ভুট্টা, সয়াবিন ইত্যাদি বিদেশ মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমানে জাপান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তি-সাশ্রয়ী উন্নত অর্থনীতিগুলোর একটি, তবে জ্বালানি শক্তির জন্য জাপান বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে জাপানের মাত্র অর্ধেক শক্তি পেট্রোলিয়ামজাত তেল থেকে আসে। অন্যদিকে জ্বালানির মধ্যে আছে কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, নিউক্লীয় শক্তি এবং জলবিদ্যুৎ (bn.wikipedia.org)।
করোনা মহামারীসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংকটের প্রভাবে ২০২১ সালে জাপানের মোট বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৪৭ ট্রিলিয়ন জাপানি ইয়েন। রফতানি ২১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছিল ৮৩ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন জাপানি ইয়েন, যা ২০০৭ সালে ছিল ৮৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ইয়েন; পাশাপাশি আমদানি ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে পরিমাণ ছিল ৮৪ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ইয়েন। রফতানি বৃদ্ধিতে শীর্ষে ছিল স্টিল ও অটোমোবাইল খাত (www.nippon.com)। জাপান ২০২১ সালে বাংলাদেশে রফতানি করেছে ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার পরিমাণ, পক্ষান্তরে আমদানি করেছে ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের দ্রব্যাদি। বাংলাদেশে রফতানীকৃত পণ্যের মধ্যে লোহা ও স্টিল, মেশিন, বয়লার, নিউক্লীয় রিঅ্যাক্টর, গাড়ি, রেলগাড়ির বগি ও যন্ত্রাংশ ইত্যাদি প্রধান (জেট্রো)। এছাড়া বাংলাদেশে জাপানের তিনশর বেশি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে এবং ব্যবসা পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ সরকার জাপানি বিনিয়োগসহ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় শুধু জাপানি ব্যবসায়ীদের জন্য একটিসহ সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে সরকার। পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার পরিপ্রেক্ষিতে জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে অধিক হারে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের অনেকের মতোই আমার কাছেও জাপান ছিল এক স্বপ্নের নাম বা স্বপ্নরাষ্ট্র। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে ‘হিরোশিমা কথা বলে’ নামের প্রবন্ধ পড়ে জাপানের জন্য খুব কষ্ট হতো, দুঃখ লাগত পারমাণবিক বোমার সেই নির্মমতার কথা জেনে। সেই থেকে জাপান ভ্রমণের অদম্য ইচ্ছা আর স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নপূরণ হলো ২০১৩ সালে যখন জাপান সরকারের বৃত্তি পেয়ে অর্থনীতি বিষয়ে দুই বছর মাস্টার্স কোর্সে পড়াশোনার জন্য জাপানের দক্ষিণের শহর ইয়ামাগুচি গেলাম। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে সরকারি দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করার উদ্দেশ্যে আবার পাড়ি দিলাম জাপানে, এবার আধুনিক শহর টোকিওতে। দুই পর্বের জাপান ভ্রমণে জাপানের আর্থসামাজিক অবস্থা, জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মানুষের আচার-ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি, বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্যটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি আর শিখতে চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি জাপানে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবস্থান এবং কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছি।
বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র জাপানের মানুষগুলো ঠিক বিপরীত অর্থাৎ তারা ক্ষমতার প্রভাব দেখায় না এবং অপব্যবহারও করে না, তারা খুব নম্র, ভদ্র, সভ্য ও বিনয়ী। জাপানিদের দেখলেই বোঝা যায় যে বিনয় মানুষকে উন্নত ও সভ্য হতে সহযোগিতা করে। কাজপাগল জাপানিরা পরোপকারী এবং খুবই আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন। নিজ কর্মের প্রতি তাদের দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্ব অন্য জাতি থেকে জাপানিদের আলাদা করেছে। তাদের সময়জ্ঞান ও পরিমিতিবোধ, পরিচ্ছন্নতা চর্চা, সৌন্দর্যবোধ ও সৃজনশীলতা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা ইত্যাদি বিষয় বর্তমান বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।
যুগ যুগ ধরে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যকার গভীর বন্ধুত্ব বিদ্যমান। ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের জনগণ একই রকমের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধারণ করে। বাংলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব সুভাস চন্দ্র বোস, রাস বিহারি বোস, জাস্টিস রাধা বিনোদ পাল এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানের রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা এবং সাহিত্য অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যা জাপানিরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এছাড়া জাপান ও জাপানিদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং উন্নয়ন ধারণার জন্য তাদের প্রতি বাংলাদেশীদের রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। দুই দেশের সার্বভৌমের প্রতীক জাতীয় পতাকার মধ্যেও রয়েছে অসম্ভব মিল। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ও জাপান এক নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আবিষ্ট। বাংলাদেশের সব প্রয়োজনে জাপান তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে জাপানকে সমর্থন দিয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তি সংগ্রামে জাপানের স্কুল শিক্ষার্থীরা তাদের টিফিনের টাকা নিয়ে আমাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল; একইভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদাতা প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে জাপান ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর এভাবেই দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার যে সুসম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল, ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান সফরের মাধ্যমে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর পারস্পরিক সহযোগিতার এ বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপানের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী বাংলাদেশ সফর করেন, যা দুই দেশের সম্পর্কে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এভাবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা জাপান-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করেছি।
জাপান আমাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী বন্ধু। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানে প্রথম সফরের সময় জাপান পদ্মা ও রূপসা সেতু তৈরিতে বাংলাদেশকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং পরবর্তী সময়ে রূপসা সেতু তৈরি করে ও পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে। দুই দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তখন ‘সংসদীয়’ ও ‘বন্ধুত্ব’ কমিটিও গঠন করা হয়। দিনে দিনে দুই দেশের সম্পর্ক আরো গভীর হতে থাকে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন কর্ণফুলী সার কোম্পানি, প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল এবং গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি শহরে পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাপানের অনুদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় ছয়জন জাপানি নাগরিক নিহত হন। সেই বেদনাহত ও শোকাবহ দিনগুলোতেও জাপানের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের পাশে ছিল, মেট্রোরেল প্রকল্প থেকে চলে যায়নি; আজ সেই মেট্রোরেল দৃশ্যমান। এছাড়া বাংলাদেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো যেমন ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ৪ ও ৫; হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প (তৃতীয় টার্মিনাল); যমুনা রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্প; কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ প্রকল্প; কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), ঢাকা-চট্টগ্রাম পাওয়ার গ্রিড শক্তিশালীকরণ প্রকল্প ইত্যাদিতে জাপান নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।
বর্তমানে জাপানে প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশী বসবাস করছেন, যাদের কেউ সেখানে স্থায়ী হয়েছেন আবার কেউ লেখাপড়া কিংবা অস্থায়ীভাবে কাজ করছেন। জাপানে অবস্থানরত আমাদের প্রবাসী বাঙালিরাও জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। জাপান তাদের স্বকীয়তা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। তাই বিশ্বায়নের এ যুগেও তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বা ভিন্ন গোত্রীয় সম্প্রদায়ের প্রভাবে তাদের নিজস্বতা হারিয়ে না যায়। এ কারণেই জাপানি রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক জীবনে বিদেশীদের তেমন কোনো প্রভাব চোখে পড়ে না। পুরো জাপানে বিশেষ করে টোকিও এবং আশপাশের শহরে বাংলাদেশীদের কিছু কার্যক্রম দেখা যায়। কিছু বাংলাদেশী ব্যবসায়ী চেষ্টা করছেন জাপানের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে, দেশকে জাপানিদের কাছে তুলে ধরতে। যদিও জাপানি ব্যবসায়ীদের বিশালতার কাছে এটি খুব ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ও প্রয়াস। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও জনসম্পদ রফতানি ব্যবসায়ীরা জাপানে ভালো প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।
জাপানে অবস্থানকালে আমি দেখেছি প্রবাসে থেকেও বাঙালিরা তাদের বাঙালিয়ানাকে ভোলেনি, বরং তারা সবসময় চেষ্টায় থাকে জাপানিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে। ব্যবসা বা রাজনীতিতে তেমন ভূমিকা না থাকলেও বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও খাবারে মুগ্ধ জাপানিরা, প্রতি বছর প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন কমিউনিটি আয়োজন করে পিঠা উৎসব, নবান্ন উৎসব কিংবা ঘুড়ি উৎসব, যেখানে অনেক জাপানি অংশ নেয়। টোকিওতে প্রত্যেক বছর বড় পরিসরে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মিলন মেলা, যা জাপানি-বাংলাদেশীদের পদচারণরায় মুখরিত থাকে। জাপানিরা নিয়মমাফিক পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলেও বাঙালি খাবার সামনে এলে তাদের ভোজনরসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা খাবার বিশেষ করে গরুর মাংস ও বিরিয়ানি তাদের খুবই পছন্দের খাবার। জাপানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালিরা সুনামের সঙ্গে পড়ালেখা ও গবেষণা করছেন, অনেকেই জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে অবদান রাখছেন। প্রবাসী অনেক শিল্পী তাদের শিল্পকর্ম, সাহিত্যকর্ম ও সমাজসেবামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, এজন্য কেউ কেউ জাপানের সম্রাটের পক্ষ থেকে ‘অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান’ পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রবাসীরা জাপানে ক্রিকেট খেলার মাধ্যমেও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, জাপান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তারা অন্যান্য দেশের দলের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে।
জাপানিরা বাঙালি পরিবারের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে, আমাদের জীবন চলা, আমাদের শিশুদের তারা খুব সহজেই আপন করে নেয়। ইয়ামাগুচি থাকতে মিজু কিদা নামের এক ভদ্রমহিলা হাজার ব্যস্ততার মাঝেও বাঙালি ছাত্র ও তাদের পরিবারকে সময় দিতেন, নিজে গাড়ি চালিয়ে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। একইভাবে কতোয়া সান, সাইতো সান কিংবা সাদাকো সান (জাপানে সম্মান প্রদর্শনে নামের সঙ্গে সান শব্দ ব্যবহার করা হয়) বাঙালিদের জন্য তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এদিক থেকে বলতে পারি প্রবাসীরা জাপানিদের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে—এটাই আমাদের সার্থকতা। আমরা আশা করি, জাপানে বসবাসরত প্রবাসী ভাই-বোনেরা প্রত্যেকে একজন দূত হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবেন, সুনামের সঙ্গে বাংলাদেশ ও জাপানের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করবেন।
লেখকঃ মুহা. শিপলু জামান : পরিচালক (প্রচার ও সমন্বয়), গণযোগযোগ অধিদপ্তর