বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যার প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এখনও হত্যার মোটিভ ও প্রকৃত আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। বেশ কিছু সিসিটিভি ফুটেজ আর সেই রাতে ফারদিনের মোবাইলের অবস্থান ধরেই চলছে মামলার মূল তদন্ত।
তবে হত্যাটির এখনও কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে সবগুলো সংস্থাই বলছে, এই হত্যার সঙ্গে রূপগঞ্জের চনপাড়ার অপরাধ জগতের কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে। কারণ ফারদিনের ফোন সেখানে বন্ধ হয়। আর লাশও উদ্ধার হয় চনপাড়ার কাছে শিতালক্ষ্যা থেকে।
এদিকে এই চনপাড়ার রয়েছে সুদীর্ঘ এক অপরাধ চক্রের ইতিহাস। হিন্দি সিনেমা ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ এর মতোই এখানে মাদক ব্যবসা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছে অপরাধের স্বর্গরাজ্য। ফারদিন হত্যার সঙ্গে সেই অপরাধ চক্রের কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তাই এখন তদন্তের মূল বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
র্যাব বলছে, ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে ফারদিন এক বন্ধুকে রামপুরায় পৌঁছে দেন। এরপর রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে কেরানীগঞ্জের টাওয়ার, ১০টা ৫৩ মিনিটে বাবুবাজারে, ১১টা ৯ মিনিটে জনসন রোড এবং রাত দুইটা এক মিনিটে যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচার টাওয়ার এলাকায় তার অবস্থান ছিল। সর্বশেষ রাত দুইটা ৩৪ মিনিটে তার মুঠোফোনের অবস্থান চনপাড়ায় পাওয়া যায়।
র্যাব সূত্র বলছে, ঘটনার দিন দিবাগত রাত দুইটা এক মিনিট থেকে দুইটা ৩৪ মিনিট পর্যন্ত ফারদিন ও সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তির মুঠোফোনের অবস্থান কাছাকাছি ছিল। ওই দুজনের একজন বাসচালক এবং অন্যজন তার সহকারী। এই দুই পরিবহনকর্মী দিনে উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ রুটে বাস চালাতেন। তারা গভীর রাতে ফাঁকা বাসে যাত্রী তুলে জিম্মি করে টাকা-পয়সা কেড়ে নিতেন। তারা চনপাড়াকেন্দ্রিক অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িত।
এদিকে ডিবির তদন্ত বলছে, রাত ১২টা ৫০ মিনিটে ফারদিনের অবস্থান ছিল গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায়। পরে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে রাত একটা ৫৯ মিনিটে আরেক বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তার তথ্য পাওয়া যায়। ঘটনার দিন দিবাগত রাত ১০টা ৫১ মিনিট থেকে ১১টা চার মিনিটের মধ্যে তিন দফায় ফারদিন একজনের সঙ্গে কথা বলেন।
ফারদিনের বাবা কাজী নুর উদ্দিন রানা বলেন, বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন মতামতে এখন পুরোপুরি বিভ্রান্ত। পরীক্ষার আগের রাতে এতো কম সময়ে রামপুরা থেকে কেরানীগঞ্জ, পুরান ঢাকা হয়ে চনপাড়া পর্যন্ত গতিবিধির কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেননা।
তার প্রশ্ন, যারা ফারদিনকে খুন করেছে তারা পরিকল্পিতভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্ত কর্মকর্তাকে ধোকা দিচ্ছে কিনা?
তিনি বলেন, মেধাবী এই ছেলেকে হারানোর পর বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাকে একবারের জন্যও কোনো সমবেদনা জানায়নি। এটিও তাকে অনেক কিছু ভাবাচ্ছে।
ফিরে দেখা চনপাড়া
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন এলাকার অসহায় মানুষকে আশ্রয় দিতে ওয়াসার খাস জমিতে পুনর্বাসন করেন এই চনপাড়ায়। এরপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে মানুষের সংখ্যা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়ায় পুনর্বাসন কেন্দ্রের অপরাধ বিস্তার ঘটে ৯০ এর দশকে। তখন থেকে প্রতারণা, ছিনতাই আর ছিচকে চোরের আবির্ভাব ঘটে। তবে ২০০০ সালের পর থেকেই অপরাধের মাত্রা বাড়তে থাকে।
মাদক, সন্ত্রাস আর খুনের স্বর্গরাজ্য যেন চনপাড়া
স্থানীয়রা জানান, গত দুই দশকে মাদক ব্যবসা আর চুরি ছিনতাই ও প্রতারণার বাহিনী গড়ে ওঠে। এসব অপরাধ আর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে গড়ে ওঠে একের পর এক নেতা। গত পাঁচ বছরে এই নেতৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে খুন হয়েছে পাঁচ জন। ২০১৭ সালে এলাকার নেতৃত্বে থাকায় খুন হয় বিউটি আক্তার কুট্টির স্বামী হাসান মূহুরী। ২০১৯ সালে বিউটি আক্তার কুট্টি নিজেই হত্যার শিকার হন। এরপর খুন হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী আনোয়ার, শামসু এবং সবশেষ সজল।
দুই ভাগে বিভক্ত এলাকার মাদক ব্যবসা। একদিকে রাজু-শাহিন বাহিনী। অন্যদিকে জয়নাল বাহিনী। এলাকার আধিপত্য ধরে রাখার জন্য এই দুই বাহিনীর হাতে প্রকাশ্যে পাঁচটি হত্যা ঘটে। তবে এলাকা যার দখলেই থাকুক না কেন দুই গ্রুপই ছিল বজলু মেম্বারের আনুগত।
তারা জানান, চনপাড়া ওয়ার্ডের টানা তিনবারের ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন বজলুর রহমান। হয়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
বজলু সম্রাজ্য
চনপাড়ায় সরকারি হিসেব মতে ছয় হাজার পরিবার বসবাস করে। প্রতিমাসে গড়ে ছয় হাজার পরিবার ৩০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পানির বিল দেয়। গড়ে ৫০০ টাকা ধরলেও মাসে পানির বিল ওঠে ৩০ লাখ টাকা। নভীর নলকূপ বসিয়ে এসব পানির লাইনের একক মালিকানা বজলু মেম্বারের। তিনি মাজারের জায়গা দখল করেও বসিয়েছেন পানির পাম্প।
তারা আরও জানান, ওয়াসার জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন বিশাল মুরগীর খামার। পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিবার প্রতি একটি করে বাড়ি পায় সবাই। তবে এখানে যারা গ্রুপ পরিচালনা করে তাদের সবারই আছে একাধিক বাড়ি। বজলু মেম্বারের বাড়ির সংখ্যা কত তার হিসেব নেই। চনপাড়া ও পাশের দুই গ্রাম মিলেয়ে ৫০টিরও বেশি বাড়ি এবং জমির খোঁজ পাওয়া গেছে এখন পর্যন্ত।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এই এলাকায় যারা চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, তারাই আবার এলাকার মাদক নির্মূল কমিটির নেতাও। শতাধিক মাদক স্পট থেকে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে চাঁদা ওঠে বজলুর নামে। স্পট প্রতি দিতে হয় তিন থেকে ১০ হাজার টাকা। মাস শেষে যার হিসেব দাঁড়ায় প্রায় ১০ লাখ টাকা।
শুধু মানুষের বাড়ি লুট, মাজারের জমি দখল বা ওয়াসার জমি দখল নয়। দুই যুগের ‘সেতুবন্ধন বিদ্যাপিঠ’ নামের স্কুলটি বন্ধ করে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নামে কমিউনিটি সেন্টার খোলা হয়েছে। তবে কমিউনিটি সেন্টারের নাম দেয়া হলেও নিজের জন্য অফিস তৈরি করেছেন বজলু। অভিযোগ আছে রাজধানী থেকে যাওয়া ভিআইপি মাদকসেবীরা এখানেই মাদক নেয়। অথচ দেড় বছর আগেও এই স্কুলে সরকারি বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এতো অপরাধের পরও কেন প্রশাসনের জোড়ালো কোনো ভূমিকা নেই এই এলাকায় তার উত্তরও দিয়েছে এলাকাবাসী।
তারা বলেন, চনপাড়ায় মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে আসায় এলিট ফোর্স র্যাবের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। পরে র্যাব অভিযান চালালে তাদের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায় রাজু-শাহিন গ্রুপের শাহিন ওরফে সিটি শাহিন।
এমন সব ভয়াবহ অপরাধে পুলিশের ভূমিকা অনেকটা নীরব দর্শকের মতো। চনপাড়ায় রাতে আইন বাহিনী ঢুকতে ভয় পায়। সিটি শাহিনের মৃত্যুর আগে দিনেও তারা যেতেন না। লুটপাটের কোনো মামলা হয় না থানায়।
তবে এমন হাজারও অভিযোগের বিষয়ে জানতে রূপগঞ্জ থানায় ওসিকে পাওয়া যায়নি। এরপর দফায় দফায় তাকে কমপক্ষে ২০ বার ফোন দেয়া হয়েছে কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
ফারদিন হত্যার সঙ্গে এই রূপগঞ্জের অপরাধ চক্রের যোগ কতটুকু আছে তা এখনও প্রমাণ হয়নি। তবে এখানে হিন্দি ছবি ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের’ মতো যে মাদক ও লুটের সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে তার ফয়সালা হওয়া খুবই জরুরি বলে মনে করেন এখানকার নিরীহ জনগণ।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার বেআইনি ।
2023 DailyNews24BD.com