বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিশাল বিনিয়োগ করতে আগ্রহ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিল। তারা তিন লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। যা মার্কিন মুদ্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।
ওই সূত্র গণমাধ্যমকে জানায়, আগামী আগস্টের মধ্যে এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করার আগ্রহ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে চিঠি দিয়েছেন এক্সন মবিলের নিউ অপরচুনিটি ম্যানেজার জনাথান উইলসন। গত ১৬ জুলাই রবিবার বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে এই চিঠি পাঠিয়েছে মার্কিন কোম্পানিটি। এর আগে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে গেছেন এক্সন মবিলের কর্মকর্তারা। এরপরই এই চিঠি পাঠানো হয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের সূত্রটি আরও গণমাধ্যমকে জানায়, চিঠিতে মার্কিন কোম্পানিটি বলেছে, বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এবার দ্বিমাত্রিক (টুডি) ও ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) জরিপ করতে চায় তারা। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি সাগরের ১৫টি ব্লকের সব ইজারা চেয়েছিল। তবে তাদের এবারের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এক্সন মবিল চিঠিতে জানিয়েছে, গভীর সমুদ্রে সম্পদ অনুসন্ধানে দ্বিমাত্রিক জরিপে ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। এতে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে ত্রিমাত্রিক জরিপ করা হবে। এতে ব্যয় হবে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া প্রতিটি কূপের উন্নয়নে ৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি গভীর সাগরে অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ১০ থেকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পুরো প্রক্রিয়া সফল হলে বাংলাদেশের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির তুলনায় প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সাশ্রয় হবে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলে তিনি তাতে নীতিগত সম্মতি দেন। তবে চূড়ান্ত চুক্তির আগে তার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। এ নিয়ে ইতিমধ্যে উচ্চপর্যায়ের কমিটি হয়েছে। চলতি বছরেই এক্সন মবিলের সঙ্গে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) হবে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, এক্সন মবিল গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোতে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কয়েক দফা চিঠি দিয়ে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এক্সন মবিল বারবার আমাদের সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সংশোধনের বিষয়টি বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি এখন মন্ত্রিসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধের পর বঙ্গোপসাগরকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক আছে ১১টি। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক আছে ১৫টি। অগভীর ব্লকে পানির গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত। এর পরে গভীর সমুদ্র ব্লক। এক্সন মবিল গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লক একসঙ্গে ইজারা পেতে চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালের পর দফায় দফায় পেট্রোবাংলা চেষ্টা করছে সমুদ্রের ব্লকগুলো ইজারা দিতে। তবে তাতে সাড়া মেলেনি।
অগভীর সমুদ্রের ৯ নম্বর ব্লকে ১৯৯৬ সালে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে কেয়ার্নস এনার্জি, যা এখন পর্যন্ত দেশের একমাত্র সামুদ্রিক গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়। মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে গ্যাসক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এছাড়া কুতুবদিয়ার সাগরতীরে গ্যাসের সন্ধান মিললেও তা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য বিবেচিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তেল-গ্যাস কোম্পানি কনোকোফিলিপস ২০০৮ সালের দরপত্র প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ নম্বর ব্লক ইজারা নিয়েছিল। দুই বছর অনুসন্ধান কাজ করার পর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মতভেদের কারণে ২০১৪ সালে ব্লক দুটি ছেড়ে দেয় কনোকো।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে ডাকা অন্য আরেক আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১-এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ও স্টেট অয়েল। পরবর্তী সময়ে কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় ব্লকগুলো ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। একই সময়ে অগভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোর জন্য ভিন্ন একটি দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এই দর প্রক্রিয়া এসএস ১১ নম্বর ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং এসএস ৪ ও এসএস ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুটি কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া (ওআইএল) ইজারা নেয়। তবে এখন শুধু ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড (ওভিএল) সমুদ্রের একটি ব্লকে কাজ করছে।