দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় গবেষণায় মুখ্য ভূমিকায় থাকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। তাই প্রতি বছর পরিকল্পনা তৈরিতে বিভিন্ন সামাজিক খাতভিত্তিক চাহিদা নিরূপণ ও বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গবেষণা করতে ২-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে মন্ত্রণালয়টির সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত এ পরিষদ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করলেও এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। চাহিদার তুলনায় কম বরাদ্দ পেলেও সে বরাদ্দ আবার ঠিকঠাক কাজে লাগছে না। বরাদ্দ দিয়েও গবেষণাপত্র না পেয়ে আবার সেই অর্থ উদ্ধারে ছুটতে হচ্ছে গবেষকদের পিছু পিছু। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক সংকটে গবেষণা বরাদ্দ ছিল না, তবে আগের বছরের বরাদ্দও সম্পূর্ণ ব্যয় করা যায়নি। তিন ধাপের বাছাই কমিটি পার করে অর্থ বরাদ্দ দিয়েও গত আট মাসে প্রায় ১০টি চুক্তি বাতিল করতে হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, ১৯৮৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিষদ থেকে মোট ৬৩৮টি গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে মাত্র ১৮টি গবেষণা হয়েছে। যদিও প্রতি বছর গড়ে আবেদন পড়ে প্রায় ২৫০টির মতো। সেখান থেকে ৭০-৮০টি আবেদন অনুমোদন পায়। গত অর্থবছরে মোট ২৫৯টি আবেদন জমা পড়লেও টিকেছে মাত্র ৫৬টি, যার মধ্যে ৩০টি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল। এ বছর গবেষণায় ২ কোটি ৪০ লাখ এবং প্রশিক্ষণে ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অনুমোদনের পর অর্থ পেয়েও গবেষণা শেষ হয় না বছরের পর বছর। এমনকি ১৯৯০ দশকের চুক্তি এখনো ঝুলছে। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে প্রায়ই এসব অর্থ বরাদ্দের চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
চুক্তি বাতিলের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৬ সালে ১৮ মাস মেয়াদে ৭০ হাজার টাকায় গবেষণা করার জন্য চুক্তি করেছিলেন ধানমন্ডির রোকেয়া আক্তার। কিন্তু ১৮ বছর অতিবাহিত হলেও এখন তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। দুই কিস্তিতে নেয়া ৩৫ হাজার টাকা ফেরত আনতে একের পর এক চিঠি দিয়ে যাচ্ছে পরিষদ। আইনি ব্যবস্থার সতর্কতাও কাজে আসছে না।
একই অবস্থা নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জামাল উদ্দিন সরকারের। ২০১৪ সালে ২৮ মাসের চুক্তি করা হয়েছিল। মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় বছর অতিক্রম হলেও চুক্তির আংশিক বরাদ্দ ২৫ হাজার টাকা ফেরত দিচ্ছেন না তিনি। গত ডিসেম্বর ও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা দেয়ার জন্য সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে তাকে।
এদিকে আমিনুল হকের ২০১০ সালের ১২ মাসের চুক্তিটা শেষ হচ্ছে না ১২ বছরেও। ডিজঅ্যাবিলিটি প্রটেকশন ট্রাস্টের এ মহাব্যবস্থাপক এক কিস্তিতে সাড়ে ১২ হাজার টাকা নিলেও তা ফেরত দিচ্ছেন না। ২০১৮ সালে গবেষণার জন্য চুক্তি হয় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অধ্যাপক তৌফিক আহাম্মদের সঙ্গে। ৩৬ মাসের গবেষণার মেয়াদ ২০২২ সালে শেষ হলেও মেইলে এবং ডাকযোগে চিঠির মাধ্যমে তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই গত ১৮ ডিসেম্বর চুক্তিটি বাতিল করা হয়। একইভাবে বিআইডিএসের প্রধান হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা সোয়া লাখ টাকায় গবেষণা করার জন্য ২০১৭ সালে চুক্তি করেন। তবে ১২ মাসের মেয়াদ থাকলেও ৬০ মাসেও গবেষণাপত্র কিংবা কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি এ কর্মকর্তার। তাই গত ডিসেম্বরে চুক্তিটি বাতিল করা হয়।
পরিষদের বাজেট কর্মকর্তা ধূসর প্রকৃতি গাইন জানান, গত বছর কৃচ্ছ্রের অংশ হিসেবে বরাদ্দ ব্যয় করা হয়নি। কিন্তু অর্থ ব্যয় না হলে বছরের শেষে টাকা ফেরত দিয়ে দেয়া হয় বলে জানান তিনি। আর এ বছর এখনো বরাদ্দ বণ্টন বা গবেষণার জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়নি।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্যমান্য গবেষকরা টাকা নিয়ে সময়মতো রিপোর্ট দিচ্ছেন না, টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। এটা সামাজিক অবক্ষয়ের একটি চিত্র। গবেষণাকে উৎসাহিত করতে জনগণের কোটি কোটি টাকা তাদের দেয়া হচ্ছে। এখন এটা নিয়ে তাদেরকে বলাটাও বিব্রতকর। আমরা শুদ্ধি আন্দোলনের কথা বলি, গণতন্ত্রায়ণের কথা বলি। কিন্তু নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ছাড়া এগুলো কীভাবে সম্ভব হবে? আমরা সাধারণত আশা করি, তারা মূল্যবোধোর চর্চা করবেন কিন্তু এখন এ অবস্থা।’
সুশিক্ষিত এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলেও অনেকে নিষেধ করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।