২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুর ও পল্লবী এলাকায় একযোগে পাঁচটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে ভাঙচুর এবং ট্রাফিক পুলিশ সদস্যকে মারধরের ঘটনার বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তদন্তে নেই কোনও অগ্রগতি। ঘটনার পরপরই পল্লবী থানা পুলিশ ও মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগের আলাদা অভিযানে গ্রেফতার হয় ১৮ জন। তবে পুলিশ সদস্যকে মারধর ও ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুরে ইন্দনদাতাদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এখনও।
বর্তমানে মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগের অধীনে তদন্তেই আটকে আছে মামলার কার্যক্রম। অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা জন্য যেই ঘটনা ঘটলো, সেই অটোরিকশাগুলো সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই।
যদিও ওই ঘটনার পরপরই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানিয়েছিলেন, পুলিশের মনোবল ভাঙতেই এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ইন্দনদাতাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এক বছর পার হলেও কার্যত কোনও অগ্রগতি দেখা মেলেনি।
সপ্তাহ দুয়েক আগে মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগে উপকমিশনার হিসেবে যোগ দেন এ বি এম মাসুদ হোসেন। ঘটনার অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ বক্স ও পুলিশ সদস্যকে মারধরের ঘটনার মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। এটি নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ছাড়া বাকি তথ্য পুরোটা জেনে পরে জানাবেন বলে জানান তিনি।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলে নির্দেশনা থাকায় এটি বাস্তবায়নে ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর সকালে রাজধানীর মিরপুর ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা কালশি এলাকায় অভিযান চালান। এ সময় তারা অভিযোগ করে বলেন, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মাসিক উৎকোচ দেওয়ার পরও বিভিন্ন সময় তাদের ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করে ডাম্পিংয়ে দেওয়া হয়। বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে হামলা চালিয়ে বসেন রিকশাচালকরা। তারা একযোগে পাঁচটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর করেন। রিকশাচালকদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় ব্যক্তিরাও। এ সময় আহত হন এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য।
ঘটনার পর বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে ডিএমপি থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ ১৮ জনকে গ্রেফতার করে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) রাজধানীর মিরপুর পল্লবী কালশি কাফরুল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অলিগলি থেকে প্রধান সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। প্রতিবন্ধী শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়াও সুস্থ ব্যক্তিরাও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছেন অলিগলি ও প্রধান সড়কে। আর এখনও এসব চলছে খোদ ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে।
যদিও ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন সময় লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে থাকেন অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে। তারপরও কার্যকর কোনও সমাধান করতে পারছে না। অটোরিকশাচালকদের দাবি, মাসিক ভিত্তিতে কার্ড করে পুলিশ সদস্য এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই সড়কে চলছে এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা।
রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর এলাকায় কথা হয় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক তরিকুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাসিক দুই হাজার টাকা দিয়ে একটি কার্ড নিতে হয়। এ কার্ড নেওয়ার পর এলাকাভিত্তিক রাস্তাগুলোয় রিকশা চালাতে হয়। পুলিশ যখন ধরে, গাড়িতে লাগানো সাংকেতিক চিহ্ন দেখেই তারা বুঝতে পারে বলে দাবি করেন তিনি। যদিও তিনি স্বীকার করেননি তার গাড়িতে কোথায় ও কী ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন রয়েছে।
ম্যানেজ না করে কোনও অটোরিকশা সড়কে চলতে পারে না দাবি করে আরেক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক সাদ্দাম বলেন, স্থানীয় নেতা ও ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করেই আমাদের অটোরিকশা চালাতে হয়। তবে প্রতিবন্ধী কিংবা শারীরিক সমস্যা রয়েছে যাদের, তাদের পুলিশ কিছুটা ছাড় দেয়। তারপরও বিভিন্ন কারণে চলতি পথে পুলিশ আটক করলে তাদের ঘুষ দিয়ে গাড়িটি ছাড়িয়ে নিতে হয়। পল্লবীর আড্ডুর নামে একজনের কাছ থেকে তিনি ‘লাইসেন্স’ বা কার্ড নিয়েছেন বলে দাবি করেন।
কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, মিরপুর পল্লবী এলাকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স কিংবা কার্ড দিয়ে থাকে আড্ডু নামে এক ব্যক্তি। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তার কয়েকটি গাড়ি রয়েছে সড়কে। তবে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স নবায়ন কিংবা কার্ড দেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
শুধু মিরপুর পল্লবী কিংবা কাফরুল নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অলিগলি ও প্রধান সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, ঘটছে নিহতের ঘটনাও। এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় উঠলেও, যাত্রীরাও থাকেন আতঙ্কে। তারপরও বাধ্য হয়ে এসব ব্যবহার করছেন তারা। এ ছাড়া বিভিন্ন সড়কে উল্টো পথে চলাচল করে জ্যাম সৃষ্টির জন্য একমাত্র দায়ী অটোরিকশা।
ট্রাফিক পুলিশ বলছে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। প্রধান সড়কে যেন চলাচল করতে না পারে, সে বিষয়গুলো নজর রাখছে তারা। ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশাগুলো অলিগলিতে চলাচল বেশি করে থাকে জানায় পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও পুলিশ সদস্যকে মারধরের ঘটনার সঙ্গে বিভিন্ন গ্যারেজের অবৈধ বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে চার্জ দেওয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তারা পঙ্গু ও প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার করে রিকশা সড়কে চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছে। আর এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও জড়িত।
কী ঘটেছিল সেদিন
২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর সকালে রাজধানীর পল্লবী এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে মিরপুর ট্রাফিক বিভাগ। এ সময় প্রতিবাদ করেন রিকশাচালকরা। প্রতিনিয়ত সড়কে পুলিশি হয়রানির শিকার হন বলে জানান তারা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে।
একপর্যায়ে কালশি ট্রাফিক পুলিশ বক্স সাগুফতা ট্রাফিক পুলিশ বক্স, মিরপুর ১২ নম্বর ট্রাফিক পুলিশ বক্স, মিরপুর অরিজিনাল ১০ ট্রাফিক পুলিশ বক্স এবং মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলা চালানো হয়। এ সময় অটোরিকশাচালকদের সঙ্গে হামলায় অংশ নেয় এই ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিরাও। শুধু পুলিশ বক্সে হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা; মিরপুর আইডিয়াল গার্লস কলেজের সামনে একজন ট্রাফিক সদস্যকে নাজেহাল ও রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করে গুরুতর আহত করে তারা।
এ ঘটনার পর মিরপুর ট্রাফিক বিভাগের এক সার্জেন্ট বাদী হয়ে পল্লবী থানায় মারধর, ভাঙচুর ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি সাধনের অভিযোগে মামলা করেন, যা এখনও তদন্তাদীন।