চাঁদ যেমন রহস্যে ঘেরা তেমনি সূর্যও রহস্যে ঘেরা। চাঁদ উপগ্রহ আর সূর্য নক্ষত্র। এই সৌরজগতে সূর্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সূর্য সব শক্তির আধার। যদিও সূর্য মহাবিশ্বের কোটি কোটি নক্ষত্রের মধ্যে একটি নক্ষত্র মাত্র। কিন্তু যেহেতু এই নক্ষত্রই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে তাই সূর্যই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সূর্যকে তাই বিভিন্ন ধর্মে দেবতার আসন দেওয়া হয়েছে। একসময় মনে করা হতো, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। বহু বছর এই ধারণা চলে আসছিল।
পরে জানা গেল যে, সূর্য না পৃথিবী বা গ্রহরাজিই যার যার নিজস্ব কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ১০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৫ হাজার ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু সূর্যের কোর বা কেন্দ্রের তাপমাত্রা ২ কোটি ৭০ লাখ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়েও বেশি। সাধারণত পারমাণবিক বিস্ফোরণে এ পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হতে পারে। সূর্যের উপস্থিতিতে দিন আর অনুপস্থিতিতে রাত হয়। যার নিজস্ব আলো আছে, তাপ আছে। চাঁদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হলো সূর্য। সূর্যের এই রহস্য জানতেই পৃথিবীর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কিন্তু চাঁদে পৌঁছানোটা যেখানে একটু সহজ সূর্যে ততটাই কঠিন। কারণ সূর্যের প্রচন্ড তাপ। সূর্য সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা দরকার। সূর্যের ব্যাস প্রায় ১৩ লাখ ৯২ হাজার কিলোমিটার যা পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ। সূর্যের ভরের তিন-চতুর্থাংশই হাইড্রোজেন। অর্থাৎ সূর্যের প্রধান উপাদান হাইড্রোজেন। এছাড়াও সূর্যে প্রচুর হিলিয়াম গ্যাস রয়েছে। অন্যান্য ভারী মৌলগুলোর মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন, কার্বন, নিয়ন ও লোহা। আমরা যাদের তারা বলি সেগুলোও কিন্তু সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু তারাগুলো অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় আমরা দূর থেকে সেগুলোকে তারা হিসেবে দেখি।
তাদের আলোর প্রভাবও আমাদের ওপর পড়ে না। কিন্তু সূর্য পৃথিবীর কাছাকাছি হওয়ায় তার তাপ এবং আলো দুটোই পাই। আকাশগঙ্গায় সূর্যের মতো বহু নক্ষত্র রয়েছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। এখন প্রশ্ন হলো সূর্য নিয়ে বিজ্ঞানীদের এত আগ্রহ কেন। পৃথিবীর শক্তির প্রধান উৎস হলো সূর্য। সূর্যের তাপ ও আলোশক্তি ব্যবহার করেই পৃথিবীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখছে বিজ্ঞানীরা। এ কারণেই সূর্যের শক্তির উৎস, সূর্যের জন্ম রহস্য এবং সূর্য যদি ভবিষ্যতে না থাকে অর্থাৎ যেভাবে নক্ষত্রের মৃতু্য হয় তাহলে কি ঘটবে এ পৃথিবীর ইত্যাদি জানার জন্য আগ্রহী বিজ্ঞানীরা। তবে আপাতত সূর্য সম্পর্কে প্রচলিত তথ্যগুলো যাচাই করা এবং আরও জোরালো অনুসন্ধান করাই মূল উদ্দেশ্য।
ভারতের আদিত্য এল-১ নামের এই যানটি মহাকাশের পরিবেশ, আবহাওয়া এবং তার ওপর সূর্যের কী প্রভাব পড়ে সেটাই জানার চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যে যানটি তার লক্ষ্যে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। তবে সূর্যকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা এটাই প্রথম নয়। নাসা তো অনেকখানি এগিয়ে। ২০২১ সালের গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, ওই বছরের শেষ দিকে নাসার যান সূর্যের বহিরাবরণ যার নাম কোরোনা সেটি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর ভেতর মধ্যাকর্ষণশক্তি প্রবল। এখানে চৌম্বক ক্ষমতাও তীব্র। একবার ঢুকলে সেখান থেকে বের হওয়া কষ্টসাধ্য। এজন্য প্রশ্ন হলো, যদি সূর্য কোনোদিন নিভে যায় বা মারা যায় তাহলে এ পৃথিবীর ভাগ্যে কি ঘটবে? কারণ এটা তো নিশ্চিত যে সূর্য একদিন স্থিমিত হবেই। সূর্যের মতো বহু নক্ষত্র মরে গিয়ে বস্ন্যাকহোলে পরিণত হয়েছে।
নাসার তথ্যসূত্রে, প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে একটি নীহারিকা (নেবুলা) থেকে আমাদের সৌরজগৎ ও তাকে কেন্দ্র করে সূর্য নামের জ্বলন্ত একটি নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়। নীহারিকা ছিল গ্যাস এবং ধূলিকণার একটি বিশাল ঘূর্ণায়মান মেঘমালা। প্রায় ৪৬০ কোটি বছরে সূর্যের প্রায় অর্ধেক জ্বালানি ইতোমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে। বাকি যা আছে তা দিয়ে মোটামুটিভাবে আরও প্রায় ৫৫০ কোটি বছর এই অবস্থায় থাকবে। কিন্তু তারপর? তারপর তো অন্য নক্ষত্রের ভাগ্যে যা ঘটেছে সূর্যের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে। সূর্যের প্রধান জ্বালানি হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন ফুরিয়ে গেলে সূর্য তাপ বিকিরণ বন্ধ করে দেবে। ক্রমান্বয়ে নক্ষত্রটি লাল দানব নক্ষত্রে পরিণত হবে। এরপর যা ঘটবে সেটি নিয়ে আমাদের আপাতত মাথা না ঘামালেও চলবে। কারণ যত দীর্ঘ প্রক্রিয়া নিয়ে সূর্য তার কার্যক্ষমতা হারাবে ততদিনে পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকার কথা না। আর থাকলেও মানুষ হয়তো বিজ্ঞানের প্রচেষ্টায় সৌরজগতের বাইরের কোনো গ্রহের খোঁজ পাবে এবং সেখানে বসবাস শুরু করতে পারে! কিন্তু যতদিন সূর্য টিকে আছে সেটিই পৃথিবীর প্রাণশক্তি।