দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে আজ থেকে ৯ মাসের জন্য পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই সময়ে পর্যটকবাহী কোনো জাহাজও দ্বীপে চলাচল করবে না। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। এর আগে গত ডিসেম্বর থেকে পর্যটক যাতায়াত নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে পর্যটক সংখ্যা সীমিত করা হয়েছিল।
ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুজিবুল হকের নেতৃত্বে পরিবেশবাদীদের একটি দল সম্প্রতি সেন্ট মার্টিন পরিদর্শন করেছেন। তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পর্যটক সংখ্যা কমানোর ফলে দ্বীপে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার, প্রবাল ও পাথর উত্তোলন এবং পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক বলেন, “সেন্ট মার্টিনে অবৈধ হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ প্রশাসনের অজানা নয়। তবে পর্যটক সীমিতকরণের ফলে দ্বীপের পরিবেশের উন্নতি হয়েছে।”
পরিবেশ সুরক্ষায় নতুন কর্মসূচি
সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর মাসব্যাপী একটি বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় দ্বীপটিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে প্লাস্টিক বোতল ও অন্যান্য বর্জ্য পরিষ্কার করা হবে। এছাড়া, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, “পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকাকালীন দ্বীপের অবস্থা নিয়মিত নজরদারিতে রাখা হবে। ২ ফেব্রুয়ারি একটি অনলাইন মিটিংয়ে সেন্ট মার্টিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হবে।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প আয়
পর্যটক যাতায়াত বন্ধের কারণে দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দাদের আর্থিক ক্ষতি পূরণে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, “দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। আমরা চাই স্থানীয়রা যেন এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হন।”
পর্যটক সংখ্যা ও নিয়ম
গত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেছেন। এই সময়ে পর্যটকদের অনলাইনে নিবন্ধন করে ট্রাভেল পাস নিয়ে যেতে হতো। নভেম্বর মাসে পর্যটকরা দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতেন, তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে দৈনিক ২ হাজার পর্যটক রাত যাপনের সুযোগ পেয়েছেন।
স্থানীয় ও বাণিজ্যিক প্রতিক্রিয়া
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “সেন্ট মার্টিনের সুরক্ষার জন্য স্থানীয় বাসিন্দা, পরিবেশকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। অবৈধ হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।”
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, অতিরিক্ত পর্যটকের উপস্থিতির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে স্থানীয় খেটে খাওয়া মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এবার পর্যটক না থাকার সময়ে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ রোধে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়। ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি দ্বীপ সংলগ্ন ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালে একটি গবেষণায় বলা হয়, পর্যটকদের রাতে থাকার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।
সর্বশেষ
সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই নিষেধাজ্ঞা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ রোধে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। এই উদ্যোগ সেন্ট মার্টিনের ভবিষ্যৎ পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়।