ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫: স্টারলিংকের মতো নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট (এনজিএসও) নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উচ্চগতির এবং কম-বিলম্বিত ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করে শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্টারলিংকের ইন্টারনেট ডাউনলোড গতি ২৫ থেকে ২২০ এমবিপিএস হতে পারে, যেখানে অধিকাংশ ব্যবহারকারী ১০০ এমবিপিএসের বেশি গতি পান। আপলোড গতি সাধারণত ৫ থেকে ২০ এমবিপিএসের মধ্যে থাকে।

বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পেসএক্স, টেসলা ও এক্স-এর মালিক ইলন মাস্কের সঙ্গে ভিডিও আলোচনা করেন। এতে বাংলাদেশের জন্য স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।

টেলিকম ও প্রযুক্তি বিশ্লেষক মোস্তাফা মাহমুদ হুসাইন বাসসের সঙ্গে আলাপকালে জানান, বাংলাদেশ ডিজিটাল অবকাঠামো আধুনিকায়নের জন্য এনজিএসও স্যাটেলাইট পরিষেবা গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

তিনি বলেন, নমনীয় নীতিমালার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে দেশজুড়ে সংযোগ বৃদ্ধি পাবে, যা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসা ও সমাজ উন্নয়নে নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।

স্টারলিংক দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বৃদ্ধির একটি ভালো বিকল্প হতে পারে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে, যেখানে প্রচলিত বাজার অপারেটরদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের মূল প্রতিষ্ঠান ভিওন লিমিটেড এবং দুবাই-ভিত্তিক একটি টেলিযোগাযোগ কোম্পানি স্টারলিংকের সঙ্গে অংশীদারিত্বে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট-ভিত্তিক মোবাইল পরিষেবা আনার সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে।

স্পেনের বার্সেলোনায় আসন্ন মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে স্পেসএক্সের সঙ্গে বাংলালিংকের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

টেলিকম বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার স্টারলিংকের সম্ভাব্য আগমনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষ ইতোমধ্যেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তাই এটি আমাদের জন্যও ভালো কিছু আনতে পারে।’ তবে, তিনি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেটের ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেন।

স্পেসএক্স দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য আলাদা মূল্য নির্ধারণ করে, যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ এই নেটওয়ার্কের আওতায় আসতে পারে। স্পেসএক্সের তথ্য অনুযায়ী, স্টারলিংক পরিষেবা ব্যবহারের জন্য কিছু সরঞ্জাম কিনতে হবে, যার মধ্যে একটি রিসিভার বা অ্যান্টেনা, কিকস্ট্যান্ড, রাউটার, ক্যাবল এবং পাওয়ার সাপ্লাই অন্তর্ভুক্ত।

স্টারলিংকের সর্বনিম্ন মাসিক ফি রেসিডেনশিয়াল গ্রাহকদের জন্য ১২০ ডলার এবং কর্পোরেট গ্রাহকদের জন্য স্টারলিংক কিট এবং মাসিক ফি দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।

মোস্তাফা মাহমুদ হোসেন বলেন, আফ্রিকার কিছু গ্রামের জন্য স্টারলিংক কম খরচে সেবা দিচ্ছে, যার মূল্য ১০ থেকে ৩০ মার্কিন ডলারের মধ্যে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন এলাকার ব্যবহারকারীরাও স্টারলিংকের আগমনে উপকৃত হবেন।

বর্তমানে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর এবং ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্যান্ডউইথ সংগ্রহ করে ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট সেবা দেয়, যা মূলত সাবমেরিন কেবল ও আন্তর্জাতিক স্থলভিত্তিক কেবলে নির্ভরশীল। স্টারলিংক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে।

স্পেসএক্স-এর তথ্য অনুযায়ী, স্টারলিংক একটি হাজার হাজার স্যাটেলাইটের সমাহার, যা পৃথিবীর আকাশসীমার নিচের স্তরে বা ৫৫০ কিলোমিটার উপরে অবস্থান করে বিশ্বব্যাপী উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে।

২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারির তথ্য অনুসারে, স্টারলিংকের মোট ৬,৯৯৪টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।

স্পেসএক্স ২০১৫ সালে স্টারলিংক প্রকল্প শুরু করে এবং ২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি চালু হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় স্টারলিংকের প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় ভুটানে।

স্টারলিংক পরিষেবা পেতে হলে গ্রাহককে একটি টেলিভিশন অ্যান্টেনার মতো ডিভাইস স্থাপন করতে হবে, যা পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। এই অ্যান্টেনার সঙ্গে একটি স্টারলিংক রাউটার সংযুক্ত করলেই ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাবে।

স্টারলিংক ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে তাদের প্রযুক্তি নিয়ে আসে।

২০২৪ সালের অক্টোবরে স্টারলিংকের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) একই মাসে একটি খসড়া নির্দেশিকা প্রস্তুত করে।

বিটিআরসি প্রস্তাবিত নির্দেশিকার নাম হচ্ছে ‘নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিস অপারেটর।’

অধ্যাপক ইউনূস ও ইলন মাস্কের মধ্যে আলোচনা চলাকালে তারা বিশেষভাবে বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তা, গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য স্টারলিংকের সম্ভাব্য ইতিবাচক পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব দেন।

তারা আলোচনা করেন যে কীভাবে উচ্চগতির ও স্বল্পমূল্যের ইন্টারনেট সংযোগ বাংলাদেশের ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে আনতে পারে এবং দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে পারে। একই সঙ্গে এটি লাখ লাখ ছোট ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বৈশ্বিক সংযোগের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।