এই শতাব্দির সবথেকে সেন্সিটিভ ও সপিস্টিকেটেড প্রযুক্তি হল সেমিকন্ডাক্টর। এখানে যে দেশের সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি যত সুক্ষ্মতায় পৌছবে, ধরে নেয়া যায় যে আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকবে সেই দেশ। বিশ্ব এখন মানুষের ডিএনএর প্রস্থের সমান মাত্র ২ ন্যানোমিটার সুক্ষ্ম প্রসেসের সক্ষমতা অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে। চিপ তৈরিতে কম ন্যানোমিটার মানে হল, আরো বেশি ট্রাঞ্জিস্টরের ঘনত্ব। আরো বেশি কম্পিউটিং পাওয়ার। আধুনিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে শুরু করে, স্পর্শকাতর মিলিটারি টেকনলজিতে মূল পার্থক্য গড়ে দিতে পারে এই লিথোগ্রাফির সক্ষমতা। ২০২৩ সালে ভোক্তা পর্যায়ে একটা ক্ষুদ্র চিপের ভেতর সবথেকে বেশি পরিমান ট্রাঞ্জিস্টর ছিল মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এপলের এম-২ প্রসেসরে। ক্ষুদ্র এই প্রসেসরে আটানো হয়েছিল ১৩৪ বিলিয়ন ট্রাঞ্জিস্টর! ৫ ন্যানোমিটারের এই প্রসেসর ফ্যাব্রিকেশন হয়েছে আমেরিকার এলাই তাইওয়ানের TSMC তে। বর্তমানে ৩ ন্যানোমিটার চিপ চলে আসছে।
আর এজন্যই আমেরিকা কোন ভাবেই চাইনা এমন প্রযুক্তি শত্রু দেশে যাক। প্রসেসর ফেব্রিকেশনের জন্য যে লিথোগ্রাফি মেশিন সেটি বিশ্বের একমাত্র কোম্পানি ডাচ ফার্ম ASML এর। এখন পর্যন্ত ফেব্রিকেশনে বিশ্বে সবথেকে বেশি শেয়ার তাইওয়ানের দখলে। আমেরিকার ইন্টেল, এনভিডিয়া সব আরো অনেক কোম্পানি এখন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাদের নিজেদের দেশেই ফেব্রিকেশন ফ্যাসিলিটি বাড়াচ্ছে। আমেরিকার টার্গেট আগামীতে বিশ্বের মোট সেমিকন্ডাক্টরের অন্তত অর্ধেক আমেরিকার মাটিতেই করার। আর এর জন্য তারা প্রচুর ভর্তুকি ও সুযোগ সুবিধা অফার করছে। কিছুদিন আগেও ইন্টেল বেশ ঘটা করে ASML এর EUV মেশিনের ডেলিভারি নিয়েছে। নতুন ফ্যাসিলিটিতে এটা তারা বছর খানেকের ভেতরেই সেটয়াপ করে ফেলবে।
এর আগে বলেছিলাম, হুয়াওয়ে মেট ৬০ তে যখন ৭ ন্যানোমিটারের টেকনোলজি আমেরিকা দেখল তখন পুরো আমেরিকা জুড়ে ভীতি আর আশঙ্কা প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু তাদের ধারনা ছিল পুরাতন DUV মেশিন দিয়েই তারা অপটিমাইজেশন করে ৭ ন্যানোমিটারে নামিয়েছে। মুলত চীনা কোম্পনিগুলি যেন কোন ভাবেই এই আধুনিক প্রযুক্তির এক্সেস না পায় তার সকল ব্যবস্থা আমেরিকা নিয়েছে।
কিন্তু এর ভেতর একটা নতুন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে জাপান। জাপানের ক্যানন কোম্পানি সামনে নিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ নতুন এক প্রযুক্তি যেটা দিয়ে ন্যানো ইমপ্রিন্ট করা সম্ভব। এবং ক্যাননের দাবি তাদের প্রযুক্তি ২ ন্যানোমিটার প্রসেসে প্রিন্ট করতে সক্ষম। একি সাথে তাদের লিথোগ্রাফি মেশিনের দাম ASML এর মেশিন হতে অনেক কম পড়বে।
এখন পর্যন্ত ডাচ ফার্ম তাদের কোন পণ্য চীনে আর রপ্তানি করতে পারছেনা কারন লিথোগ্রাফির এই প্রযুক্তি মূলত আমেরিকান প্রযুক্তি। ক্যাননের ক্ষেত্রে যেহেতু FPA-1200NZ2C নিজস্ব প্রযুক্তি, সেক্ষেত্রে ক্যাননের ক্ষেত্রে চীনে রপ্তানি করার বাধা থাকার কথানা। তবে আমেরিকা কি সেটা হতে দিবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।
রাশিয়ার চিপ কোম্পানি মাইক্রন নিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি ১৯৮০ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে দারুন ক্ষমতা দিলেও সোভিয়েত ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই কোম্পানি আর আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে পারেনি। ২০২০ সালে এসে তারা ৬৫ ন্যানোমিটার প্রসেস উৎপাদন শুরু করেছে যেটা TSMC ২০০৫ সালে আর ইন্টেল ২০০৭ সালেই শুরু করেছিল। সেমিকন্টাডক্টরে রাশিয়ার পিছিয়ে থাকা রাশিয়ার সকল প্রযুক্তিকেই মোটামুটি পিছিয়ে রাখছে যা আধুনিক সক্ষমতার হয়ে উঠার পথে বাধা। এ কারনে রাশিয়া চেষ্টা করছে যেকোন উপায়ে মাইক্রনের সক্ষমতা বৃদ্ধির। যদি ক্যাননের কাছ থেকে লিথোগ্রাফি প্রযুক্তি চীন হস্তগত করতে পারে আর সেটা যদি রাশিয়ার হাতে পড়ে তবে ধরে নেয়া যায় রাশিয়া হয়ত দ্বিতীয় গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখবে।