মগবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী বলছে ফায়ার সার্ভিস, চারিদিকে গুঞ্জন রহস্যময় বিস্ফোরণ
রাজধানীর মগবাজারের আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর ভবনটি যেন একটি ধ্বংসস্তূপ। ভয়াবহ বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন অবস্থা ভবনটির। সেখানে এখন শুধু ভাঙ্গা ইট-পাথর আর রড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। প্রতিদিনের কোলাহলপূর্ণ এলাকাটিতে এখন সুমসাম নিরবতা। ভয়াবহ বিস্ফোরণের মুহূর্তটি মনে করে এলাকার বাসিন্দারা শিউরে উঠছেন। হতাহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। যেন একটি দুঃস্বপ্ন তাদের কেড়ে নিয়েছে সবকিছু।
এ দিকে বিস্ফোরণ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। ইতোমধ্যে বিস্ফোরণের কারণ ও উৎপত্তি জানতে কাজ শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা। এ জন্য ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, তিতাস গ্যাস, বিস্ফোরক পরিদফতরের পক্ষ থেকে গঠিত হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি।
শুধু গ্যাস লিকেজে এত বড় বিস্ফোরণ হয় না : শুধু গ্যাস লিকেজ কিংবা সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এত ক্ষয়ক্ষতি হয় না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে এটা আলাদা। এত বড় বিস্ফোরণের কারণ কী সেটা নিয়ে আমরাও দুশ্চিন্তায় আছি। এর পেছনে আরো কোনো কারণ থাকতে পারে। সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও আশপাশের এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন বিস্ফোরক পরিদফতরের অ্যানার্জি অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমাদের তিনজন পরিদর্শক পরিদর্শন করে গেছেন। গতকাল সোমবার আমরা গ্যাস ডিটেক্টরের মাধ্যমে পরীক্ষা করে ঘটনাস্থলে হাইড্রোকার্বনের অস্তিত্ব পেয়েছি, যা প্রাকৃতিক গ্যাস অর্থাৎ সরকারিভাবে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, বিস্ফোরক পরিদফতর থেকে আমরা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে ধারণা করছে পরিদফতর। অনেকে অনেক ধরনের ধারণা ও মত পোষণ করছেন। আমরা অধিকতর তদন্ত সাপেক্ষে সুস্পষ্ট কারণ বলতে পারব। তিনি বলেন, বিস্ফোরণ এককভাবে এমনি এমনি হয় না। আশপাশে যদি আগুন থাকে, সিগারেট বা কোনো স্পার্ক থেকে হতে পারে। ইলেকট্রিক্যাল এক্সপ্লোরেশন হতে পারে। আমাদের আরো তদন্ত করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি : বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ওই ভবনে গ্যাস জমেই ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন। তিনি জানান, তদন্ত কমিটি গতকাল সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান।
দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে গ্যাস জমেই ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে তারা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন। ভবনের যে অংশে শর্মা হাউজ, সে অংশটি তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শর্মা হাউজে গ্যাস সিলিন্ডার ছাড়াও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছিল। বেঙ্গল মিটেও ব্যবহৃত হতো কমপ্রেসার মেশিন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। এ ছাড়া দোতলায় সিঙ্গারের শোরুম ও গুদামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়াও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ছিল বিপুলসংখ্যক।
ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী : বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত তিনতলা ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। গতকাল দুপুরে ভবনটির সামনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ভবনটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। মেরামত করেও ভবনটি ব্যবহার করা যাবে না। কারণ ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। এর ওপরে আরো দু’টি ফ্লোর রয়েছে। বর্তমানে এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
যেকোনো সময় ভবনটি ভেঙে পড়তে পারে। সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এই ভবনে যেন কেউ প্রবেশ না করেন। পরে কোনো ধরনের বিপদের সম্মুখীন যাতে কেউ না হন। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে আশপাশের ভবনের কাচ ভেঙে পড়া বা দেয়ালে আঘাতের আলামত পাওয়া গেছে। ভবনের মালিককে বিষয়টি অবগত করা হবে। ভবনটি ভেঙে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে : আইজিপি
বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এখন পর্যন্ত এই বিস্ফোরণ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না। গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হতে পারে। ভবনের ভেতরে এখনো মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। বোম্ব এক্সপ্লোরেশন ইউনিট নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিস্ফোরণের কারণ তলিয়ে দেখা হবে বলে জানান আইজিপি। গতকাল বেলা ১১টার দিকে পরিদর্শনে আসেন আইজিপি।
পুলিশের ৭ সদস্যের কমিটি : বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দফতর। কমিটির প্রধান করা হয়েছে পুলিশের জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামানকে। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এই কমিটির কথা জানানো হয়। কমিটি গঠন করেন পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মোহাম্মদ আইয়্যুব।
কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেনÑ সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার, স্পেশাল ব্রাঞ্চের (সিটি-এসবি) বিশেষ পুলিশ সুপার, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের বোম ডিস্পোজাল ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এয়ারপোর্ট এপিবিএনের ক্রাইসিস রেসপন্স টিমের সহ-অধিনায়ক, কাউন্টার টেরোরিজমের বোম ডিস্পোজাল ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং বিস্ফোরক পরিদফতরের উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক।
পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, কমিটি মূলত বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান এবং এ ধরনের বিস্ফোরণ প্রতিরোধে সুপারিশ তুলে ধরবে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও এই কমিটিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের গঠিত কমিটির তদন্ত কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে বলা হয়েছে।
আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডি : বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা কিনা তা তদন্ত করছে পুলিশ। বিস্ফোরণের সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধানে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ও ক্রাইম সিন ইউনিট। গতকাল দুপুর ১২টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা ক্রাইম সিন ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিস্ফোরণটা মারাত্মক ছিল। প্রাথমিকভাবে নানা কারণ উঠে এলেও বিস্ফোরণের সঠিক কারণ এখনো নিশ্চিত না। বিস্ফোরণের আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখা হবে। আমাদের চৌকস দল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এরিয়া কর্ডন করে আলামত সংগ্রহ করছে।
ঘটনা তদন্তে তিতাসের কমিটি : বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এরই মধ্যে তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে তিতাসের মহাব্যবস্থাপক (ভিজিল্যান্স) সাইফুল ইসলাম চৌধুরীকে। সদস্যসচিব হিসেবে রয়েছেন তিতাসের জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক সাখাওয়াত হোসেন। এ ছাড়া সদস্য করা হয়েছে তিতাসের বিপণন বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক সত্যজিৎ ঘোষকে।
এ দিকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী ইকবাল মো: নুরুল্লাহ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর বলেছেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাসের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। শরমা হাউজ ও তার দুই পাশের ভবনে তিতাসের কোনো গ্যাস সংযোগ নেই। ঘটনাস্থলে এলপিজির সিলিন্ডার দেখতে পেয়েছেন তিতাসের তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
প্রসঙ্গত, গত রোববার রাতে বিস্ফোরণে বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকার ৬৯ আউটার সার্কুলার রোডে মূল সড়ক ও আশপাশ। এই বিস্ফোরণে নারী ও শিশুসহ এখন পর্যন্ত সাতজন মারা গেছেন। অন্য দিকে ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ তথ্যে মোট ৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তির কথা জানা গেছে। এর বাইরে অর্ধশতাধিক আহত ব্যক্তি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।