বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের পুণ্যলগ্ন শুভ মহালয়া হয়ে গেছে গত বুধবার। এদিন থেকেই শুরু দেবীপক্ষের। আর দুদিন পরই ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে দুর্গাপূজা শুরু। ১৫ অক্টোবর শুক্রবার বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে বিদায় নেবেন দেবী। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ জানিয়েছে, ঢাকা মহানগরে পূজামণ্ডপের সংখ্যা ২৩৮ ।
এ বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ১১৮টি দুর্গাপূজা হবে, যা গত বছরের চেয়ে ১ হাজার ৯০৫টি বেশি । এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
যেভাবে শুরু হলো দুর্গাপূজা
দুর্গাপূজা কবে কখন এবং কোথায় শুরু হয়েছিলো তা নিয়ে অনেকও মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। এছাড়া আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অপরদিকে অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের। তারা পূজীত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রুপে।
ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় ২২০০০ বছর পূর্বে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত হয়েছিলো। সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা অারো অাধুনিক এবং বিস্তৃত হয়। এছাড়া প্রাচীন সাহিত্যের দিকে তাকালে অামরা দেখতে পাই মূল বাল্মীকির রামায়ণে দূর্গাপূজার কোন অস্তিত্ব নেই কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে এর অস্তিত্ব বিদ্যমান।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করার সময় মূল রামায়নের বাহিরে তৎকালীণ বাঙ্গালী সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও বিভিন্ন অনুসঙ্গ প্রবেশ করিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে বাংলা রামায়ণ অারো অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন।
তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দূর্গাপূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে শক্তিশালী রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রী রামচন্দ্র কালিদহ সাগর থেকে ১০১ টি নীলপদ্ম সংগ্রহ করে প্রাক প্রস্তুতি গ্রহণ করে দেবী দূর্গার কৃপালাভ করেন বলে কৃত্তিবাস ওঝা বর্ণনা করেছেন।
দুর্গাপূজার সবচেয়ে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় মার্কন্ডেয় পুরাণে। এই পুরাণের মধ্যে ১৩ টি অধ্যায় দেবীমহাত্ম্যম নামে পরিচিত। বাংলায় শ্রীশ্রী চন্ডি নামে সাতশত শ্লোক বিশিষ্ট দেবী মহাত্ম্যম পাঠ আছে যা দুর্গাপূজার প্রধান ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শ্রীশ্রী চন্ডি অনুসারে এই দেবীই `নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ` বা সব দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি।
দেবী দূর্গার বাহন সিংহ। বাংলায় দেবী দূর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দূর্গার মূর্তি।এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দূর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী, তাঁর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষী ও নিচে গণেশ, বামপাশে উপরে দেবী স্বরস্বতী ও নিচে কার্তিক।
সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশমী অবধি পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দূর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে আখ্যায়িত । দূর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষী পূজায় তার সমাপ্তি।
অাধুনিক দূর্গাপূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ম শতকে নানা বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসায়ী, রাজদরবারের রাজকর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল।বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে (১৭৬৭) দূর্গাপূজা হতো বলে লোকমুখে শোনা যায়।
এছাড়া পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের পাটনাতে ১৮০৯ সালের দূর্গাপূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। ওরিষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দূর্গাপূজা হয়ে আসছে ।জমিদার বাড়ি থেকেই এই পূজার প্রচলন হয়েছিল। বর্তমানে দূর্গাপূজা মূলত দুইভাবে হয়ে থাকে ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিক ও সমষ্টিগতভাবে -ব্যক্তিগত পূজাগুলি নিয়মনিষ্ঠা ও শাস্ত্রীয় বিধান পালনে বেশি আগ্রহী হয়।
এ ধরনের পূজাগুলো বিত্তশালী বাঙ্গালী পরিবারগুলোতে হয়ে থাকে অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে যৌথ উদ্যোগে যে পূজাগুলো হয় সেগুলো মূলত সর্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা নামে পরিচিত। বৃটিশ শাসনের অবসানের পর এই পূজা বাংলায় অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বাঙ্গালী হিন্দুদের অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।
এছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সনাতন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই পূজা ব্যাপক সমারোহে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে ব্যাপক সমারোহের মাধ্যমে এই সার্বজনীন দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
পরিশেষে আমরা আমাদের সমাজের সর্ব প্রকার দমন, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, নির্যাতন, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বর্গীয় অমীয় শান্তি স্থাপনের মধ্যদিয়ে সমাজের জন্যে সার্বিক কল্যানকর কাজ করবো, এবারের দূর্গাপূজার প্রণাম মন্ত্র থেকে এই হোক সকলের দৃঢ় অঙ্গীকার।
সুত্রঃ লেখক: সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী