৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯। চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বিশ্বকে জানাল যে, চীনের হুবে প্রদেশের উহান শহরের কিছু মানুষের দেহে একটি নতুন ধরনের ভাইরাস খুঁজে পেয়েছে তারা। এই ভাইরাসের কারণে নিউমোনিয়া জাতীয় সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
তার প্রায় আড়াই মাস পরে ১১ মার্চ ২০২০, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বে ভাইরাসটির প্যান্ডেমিক অবস্থা ঘোষণা করলেন। কোন একটি জীবাণু বা রোগ একটি জায়গা থেকে শুরু হয়ে অনেকগুলো জায়গা, দেশ, কনটিননেন্ট ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে, এই অবস্থাটিকে প্যান্ডেমিক বলে। এ পর্যন্ত ১২টি ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে, তার চারটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে। ওমিক্রন ১৩তম ভ্যারিয়েন্ট।
বেশির ভাগ ভাইরাস মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর দেহে থাকে। কোনো একটি ভাইরাস তার গঠনে কোনো মিউটেশন বা পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের দেহে আক্রমণের উপযোগী হয়ে উঠলে মানুষের দেহে প্রবেশ করতে থাকে। তারপর একজনের দেহ থেকে আরেক জনের মধ্যে ছড়াতে গিয়ে আরও কিছু মিউটেশন বা পরিবর্তন হতে পারে। এই পরিবর্তনের ফলে নতুন কারো দেহে পুরনো ভাইরাসের পরিবর্তিত নতুন রূপটি হয় দুর্বল হতে পারে অথবা আগের চেয়ে শক্তিশালী ভাইরাসে পরিণত হতে পারে। ভাইরাসের এমন পরিবর্তিত রূপকে বলে ভ্যারিয়েন্ট।
এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসটিতে কয়েক শ পরিবর্তিত রূপ এসেছে। জীবন চক্রে একটি ভাইরাসের এমন পরিবর্তন স্বাভাবিক। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সব পরিবর্তন নিয়ে চিন্তা করেন না। কোনো পরিবর্তনের কারণে নতুন ভ্যারিয়েন্ট যদি আগের চেয়ে মারাত্মক হয়ে ওঠে, তখন বিজ্ঞানীরা সেটার ওপর বেশি ফোকাস দেন। গত দুই বছরে এ ধরনের চারটি প্রধান ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আলফা, বিটা, গামা এবং ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট। আলফা ভ্যারিয়েন্ট যা প্রথম ইংল্যান্ডে দেখতে পাওয়া যায়, বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হলো—B.1.1.7। শুরুতে বলা হতো uk ভ্যারিয়েন্ট বা কেন্ট ভ্যারিয়েন্ট। বিটা ভ্যারিয়েন্ট খুঁজে পাওয়া গেল সাউথ আফ্রিকাতে, নাম দেওয়া হলো—B.1.351, একেও সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ডাকা হতো। গামা ভ্যারিয়েন্ট প্রথম পাওয়া গেল ব্রাজিলে, নাম দেওয়া হলো—P.1, যা ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট নামে পরিচিতি পায়। ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট, যা ইন্ডিয়াতে প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, নাম দেওয়া হলো—B.1.617.2। শুরুতে নাম দেওয়া হয়েছিল ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্ট। কিন্তু নতুন পাওয়া ভ্যারিয়েন্টির নাম নিয়ম অনুযায়ী ১৩তম গ্রিক অ্যালফাবেট নু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেটার নাম নু রাখলেন না। নতুন ভ্যারিয়েন্ট B.1.1.529-এর নাম রাখলেন ওমিক্রন (Omicron)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করেন। ১. Variants Being Monitored সংক্ষেপে VBM ২. Variant of Interest বা সংক্ষেপে VOI ৩. Variant of High Consequence বা সংক্ষেপে VOHC ৪. Variant of Concern ev msGÞGc বা সংক্ষেপে VOC। Omicron ভ্যারিয়েন্টটি হচ্ছে Variant of Concern।
এর আগে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছিল একমাত্র Variant of Concern। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টটির স্পাইক প্রোটিনে ১২টি মিউটেশন বা স্পাইক প্রোটিন সাবস্টিটিউশন ঘটেছিল। কিন্তু সর্বশেষ ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনে এ রকম স্পাইক প্রতিটি ৩৪টি পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের তীব্রতা, ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা এবং ভ্যাকসিন অকার্যকর হওয়ার আশঙ্কা ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দ্বিগুণ হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও চিকিত্সকগণ।
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটির আগে এই বছরের শুরুতে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টটি এই রকম মিউটেশনের মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে ওঠেছিল। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটিতে ডেলটার চেয়ে দ্বিগুণ পরিবর্তন লক্ষ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
যে কারণে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এটি আরও দ্রুত ছড়াতে পারে, অথবা ভ্যাকসিনগুলো এর বিরুদ্ধে ভালো কার্যকর নাও হতে পারে।
ওমিক্রন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ অভিমত: ১. Transmissibility: এখনো পরিষ্কার নয়, এটি ডেলটার চেয়ে দ্রুত ছড়াবে কি না। ২. Severity of disease: ভ্যারিয়েন্টটির আক্রমণে শরীর আগের চেয়ে অথবা আগের ভেরিয়েন্টগুলোর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, অসুস্থ অথবা জীবননাশের মতো মারাত্মক হয়ে উঠবে কি না, এটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এখনো পরিষ্কার নয়। ৩. Effectiveness of prior SARS-CoV-2 infection: ধারণা করা হচ্ছে যে আগে অন্য কোনো ভ্যারিয়েন্ট বা মূল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও পুনরায় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শরীরকে আক্রান্ত করতে পারে। ৪. Effectiveness of vaccines: ভ্যাকসিনগুলো নতুন ভ্যারিয়েন্টটির ওপর পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর কি না, এটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে পরিষ্কার নয়। এ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে।
৫. Effectiveness of current tests: শুধু PCR টেস্টের মাধ্যমে এই ভেরিয়েন্টটি শনাক্ত করা যায়। ৬. Effectiveness of current treatments: এখনো পর্যন্ত কেবল কর্টিকোস্টেরয়েড এবং IL 6 রিসেপ্টর ব্লকার ভ্যারিয়েটটির ওপর চিকিৎসা হিসাবে কার্যকর।
লেখক: চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক, লন্ডন, ইংল্যান্ড।