দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে। তবে এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য। কিডনি রোগের ঝুঁকি এবং এই রোগ প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা জরুরি। একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরও দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন।
‘কিডনি সুরক্ষায় জ্ঞানের বিস্তার অপরিহার্য’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সমাজের বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে বেসরকারি সংগঠন কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) ও প্রথম আলো । গোলটেবিলের সায়েন্টিফিক পার্টনার ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
বিশ্ব কিডনি দিবস (১০ মার্চ) সামনে রেখে আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে দেশে কিডনি রোগের পরিস্থিতি, আক্রান্ত রোগীদের দুর্ভোগ, চিকিৎসাব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য জনবলের ঘাটতির বিষয়টিও উঠে এসেছে। কিডনি রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। বৈঠক থেকে সরকার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের করণীয় বিষয়ে কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে দেওয়া ভিডিও বার্তায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই রোগের চিকিৎসা ব্যয় এত বেশি যে ১০ শতাংশ মানুষও চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে না। চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যায়। এই রোগের চিকিৎসা ব্যয় বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
বৈঠকে মূল উপস্থাপনায় কিডনি রোগের ব্যাপকতা, পরিণতি এবং প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দেন ক্যাম্পসের সভাপতি অধ্যাপক এম এ সামাদ। তিনি বলেন, কিডনি রোগের ঝুঁকি ও তা প্রতিরোধের জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও সচেতন ও দক্ষ হওয়ার দরকার আছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা আছেন তাঁদেরও বিষয়টি বুঝতে হবে। এই রোগের প্রাদুর্ভাব কমাতে ‘কিডনি সুরক্ষা বিমা’ চালুর প্রস্তাব করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, কিডনি রোগ আছে এমন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ জানেই না যে তারা এই রোগে আক্রান্ত। কিডনি রোগ বিষয়ে জ্ঞান তৈরি ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গবেষণা করা হবে বলে জানান তিনি।
দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে ব্যবহার করে কিডনি রোগ শনাক্তের সুপারিশ করেছেন কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক কিডনি সমিতি কোনো ব্যক্তির কিডনি রোগ আছে কি না, তা জানার জন্য সাতটি প্রশ্ন ঠিক করেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর না–সূচক হলে বুঝতে হবে ওই ব্যক্তি কিডনি রোগে আক্রান্ত নন।
সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশে কিডনি রোগ নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই, কোনো কৌশলপত্র নেই, কোনো নির্দেশিকা নেই। তিনি এও বলেন যে সরকার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না কোথা থেকে শুরু করতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এম এ সালাম বলেন, ১০ শতাংশ নারী–পুরুষ মূত্রাশয়ের অস্বস্তিতে ভোগেন। অনেকে নিরাময়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন। কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কিডনির ক্ষতি করে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
কিডনি সুরক্ষা নিয়ে আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে অন্য রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরাও বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে বিএসএমএমইউর হৃদ্রোগ বিভাগের অধ্যাপক হারিসুল হক বলেন, ‘হার্ট ফেইলর’ রোগীদের ৯০ শতাংশ একটা পর্যায় গিয়ে কিডনি রোগে ভোগে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুল হালিম বলেন, কিডনি রোগে ভুগছেন এমন নারীদের গর্ভধারণ করা ঠিক কি না বা এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, সে বিষয়ে আরও জ্ঞান দরকার।
অনেক শিশুর কিডনির আকার স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হয় বলে জানান বিএসএমএমইউর শিশু নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রঞ্জিত রঞ্জন রায়। তিনি বলেন, শিশুদের মধ্যে যাদের এমন সমস্যা রয়েছে তাদের চিকিৎসা ও সেবায় বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।
কিডনি বিষয়ে জ্ঞান বিস্তারের আগে জ্ঞান তৈরি দরকার বলে মন্তব্য করেন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, অনেক বিষয়ে জ্ঞান নেই, তথ্যপ্রমাণ নেই। এ জন্য গবেষণা দরকার।
কিডনি রোগ নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করে দেখা গেছে, মানুষের মধ্যে আগের চেয়ে সচেতনতা বেড়েছে—এমন তথ্য বৈঠকে তুলে ধরেন ক্যাম্পসের নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ান সালেহীন।
গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ থাকলে কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। স্থূলতা, ধূমপান, অলস জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ভেজাল খাদ্য কিডনি রোগের ঝুঁকি তৈরি করে। ডায়রিয়া, বমি বা শরীরে পানিশূন্যতাও কিডনি রোগ সৃষ্টি করতে পারে। ব্যথানাশক ওষুধ কিডনিকে অসুস্থ করে তোলে। এসব ক্ষেত্রে দরকার সচেতনতা। এই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে সরকার ছাড়াও আরও অনেকের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি এ ব্যাপারের নিজেদের অভিজ্ঞতা ও বক্তব্য তুলে ধরেন।
৪০ বছর নিয়মিত হাঁটার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঢাকায় কাজ করে একজন মানুষ গ্রামের পাঁচজন মানুষের জীবন চালায়। ঢাকার সেই মানুষটির স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধানে কাজ করতে হবে।
ঢাকা মহানগরের রাস্তা মানুষের হাঁটার জন্য অনুপযুক্ত করে তোলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, ঢাকায় এক কিলোমিটার পর পর ডায়ালাইসিস কেন্দ্র না করে, এক কিলোমিটার পর পর প্রক্ষালনকেন্দ্র করা জরুরি।
একবার বড় একটি ম্যাচের আগে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে কী বিপদে পড়েছিলেন, তার বর্ণনা দেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক অনেক কম।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, কিডনি রোগের কারণ, প্রতিরোধ, প্রতিকার এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে সাংবাদিক, কলাম লেখক, কবি–সাহিত্যিক সবাই ভূমিকা রাখতে পারেন।