বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস আজ (১৭ মে)। দিবসটিকে ঘিরে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে— “সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন।”
আজ বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। মানবশরীরের নীরব এক ঘাতকের নাম উচ্চ রক্তচাপ। সমগ্র বিশ্বে ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি চারজনে মধ্যে একজন ভুগছেন উচ্চ রক্তচাপে। এদেশে প্রায় ৮৯ হাজার ৪০০ রেজিস্ট্রার্ড হাইপারটেনশনের রোগী আছে। এর বাইরেও অসংখ্য রোগী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ, পক্ষাঘাত, অন্ধত্বসহ অনেক রোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান।
ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন লিগের (ডাব্লিউএইচএল) সদস্য হিসেবে হাইপারটেনশন কমিটি অব ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, ২০০৬ সাল থেকে ১৭ মে দিবসটি পালন করে আসছে। এবছরও জনসচেতনতায় এ দিবসকে ঘিরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিবসটিকে ঘিরে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন।’
বাংলাদেশ সরকার নন কমিউনিকেবল ডিজিজ রোধে নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। সরকার প্রান্তিক পর্যায়ে সেবা দিতে কমিউনিটি ক্লিনিকেও উচ্চ রক্তচাপ মাপার যন্ত্র দিয়েছেন। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসায় সরকার ২০০ টি উপজেলায় তিনটি করে ওষুধ ফ্রি দিচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এনসিডি কর্নার থেকে এ ওষুধ নিতে পারবেন রোগীরা। ওষুদের পাশাপাশি ৮০ টি উপজেলায় ডিজিটালভাবে রোগীর তথ্যসংগ্রহ নিবন্ধন ও ফলোআপ করা হচ্ছে।
জেনেনিনঃ রক্তচাপ পরিমাপের সঠিক উপায় !
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপের বিকল্প নেই।
বলা হয়ে থাকে, উচ্চ রক্তচাপ এক নীরব ঘাতক। কিন্তু এই ঘাতক তো বলেকয়ে বিপদ ডেকে আনে না। তাই রক্তচাপ সম্পর্কে সচেতন থাকার বিকল্প নেই। সচেতন থাকতে নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে হবে। কে না–জানে, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ব্যবহারের জন্য সহজ যন্ত্র হচ্ছে রক্তচাপ মাপার যন্ত্র। তবে অবশ্যই সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ জানা থাকতে হবে।
বর্তমানে রক্তচাপ পরিমাপে চিরাচরিত (ম্যানুয়াল) যন্ত্রের পাশাপাশি ডিজিটাল যন্ত্রও ব্যবহৃত হয়। তবে রক্তচাপ মাপতে কোন যন্ত্রে আস্থা রাখা উচিত, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে উঁকি দেয়। প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। বলা যায়, এখন অনেক ডিজিটাল যন্ত্র বের হয়েছে। তবে এসব এখনো চিকিৎসকের পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে পারেনি। চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়, কেউ যদি ম্যানুয়াল যন্ত্রে না মাপতে পারেন, সে ক্ষেত্রে ডিজিটাল যন্ত্রে মেপে ধারণা পেতে পারেন। কিন্তু কত বার মাপবেন?
অনেক সময় একই রোগীর কয়েকবার রক্তচাপ মেপে দেখা হয় । শুরুতে একজন রোগীর হয়তো বেশি ব্লাডপ্রেশার (রক্তচাপ) পাওয়া গেলে, তাঁকে আবার পাঁচ–ছয় মিনিট পর আবার মেপে দেখা হয়, মাপটি ঠিক রয়েছে কি না। কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে কয়েকবার মাপতে হয়। যেমন: ডায়াবেটিস থাকলে একবার বসিয়ে মাপা হয়, একবার দাঁড় করিয়ে মাপা হয়।
রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র বাড়িতে রাখার প্রয়োজনীয়তা
বাড়িতে রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র থাকলে সহজেই রক্তচাপ পরিমাপ করা যায়। রক্তচাপ প্রতিদিন মেপে রাখলে এই ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট ফলোআপ করতে সুবিধা হয়। ওষুধ সেবনের সময়ে বা শারীরিক ব্যায়াম করার সময়, বা অন্য কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হতে চাইলে, রক্তচাপের ওপর প্রভাব পরিমাপ ও মূল্যায়ন করতে পারেন। বাড়িতে রক্তচাপ মাপার যন্ত্র থাকলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়।
যে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে
রক্তচাপ মাপার আগে যেকোনো মানসিক চাপ বা কোনো শারীরিক ক্রিয়াকলাপ রক্তচাপের পরিমাপকে প্রভাবিত করতে পারে। বাহুতে মনিটরের কাফ ভুলভাবে ভুল জায়গায় বাঁধলেও ত্রুটিপূর্ণ রিডিং আসতে পারে। সঠিক রিডিং পেতে, এটি অবশ্যই কনুইয়ের ঠিক ওপরের অংশের উপরের বাহুতে ঠিকভাবে বাঁধতে হবে।
যা করবেন, যা করবেন না
রক্তচাপ মাপার আগে প্রস্তুত হয়ে নিন। এ জন্য অন্তত এক ঘণ্টা আগে কোনো কায়িক পরিশ্রম, ব্যায়াম বা খেলাধুলা করবেন না। চা-কফিও এক ঘণ্টার মধ্যে পান করবেন না।
রক্তচাপ মাপার আগে ১০ মিনিটের জন্য আরাম করুন এবং প্রসাব করে নিন। পা গুটিয়ে বা আড়াআড়ি (ক্রস) করে বসবেন না। পা মাটিতে ছুঁইয়ে রাখুন। বাহু কোনো স্ট্যান্ড বা টেবিলে রাখুন, যাতে এটি প্রসারিত না হয়। বাহুতে খুব শক্তভাবে কাফ বাঁধবেন না। পরিমাপের সময় বারবার কথা বলবেন না বা যন্ত্র স্পর্শ করবেন না।
কীভাবে মাপবেন
রক্তচাপ মাপার যন্ত্রটির কাফের নিচের প্রান্ত কনুইয়ের সামনের ভাঁজের ২ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার ওপরে ভালোভাবে আটকাতে হয়। কনুইয়ের সামনে হাত দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনির অবস্থান স্থির করে তার ওপর স্টেথোস্কোপের ডায়াফ্রাম বসানো হয়। ডায়াফ্রাম এমনভাবে চাপ দেওয়া উচিত, যেন ডায়াফ্রাম ও ত্বকের মাঝখানে কোনো ফাঁক না থাকে।
চাপ মাপার সময় কাপড় কিংবা কাফের ওপরে স্টেথোস্কোপ রাখা যাবে না। রক্ত চাপমান যন্ত্রের ঘড়ি হৃদ্পিণ্ডের একই তলে অবস্থান করতে হবে। এরপর রেডিয়াল ধমনি অনুভব করা হয় এবং ধীরে ধীরে চাপমান যন্ত্রের চাপ বাড়ানো হয়।
রেডিয়াল পালস বন্ধ হওয়ার পর চাপ ৩০ মিলিমিটার ওপরে নেওয়া হয়। তারপর আস্তে আস্তে চাপ কমানো হয়। প্রতি বিটে সাধারণত দুই মিলিমিটার চাপ কমানো হয়। তাড়াতাড়ি চাপ কমালে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এবার চাপ কমানোর সময় স্টেথোস্কোপ দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনিতে সৃষ্ট শব্দ মনোযোগের সঙ্গে শোনা হয়। চাপ কমতে শুরু করলে রক্ত চলাচলের ফলে এক ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয়। একে করটকফ শব্দ বলা হয়। করটকফ শব্দ ধাপে ধাপে পরিবর্তন হয়। এই শব্দের ধরন অনুসারে পাঁচটি পর্যায় রয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে এক ধরনের তীক্ষ্ণ শব্দের সৃষ্টি হয়। এটা সিস্টোলিক রক্তচাপ নির্দেশ করে। যে চাপে শব্দ বন্ধ হয়ে যায় সেটাকে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ বলা হয়। এককথায় শব্দ যখন শুরু হবে সেটা সিস্টোলিক এবং শব্দ যখন শেষ হবে সেটা ডায়াস্টোলিক।
রক্তচাপের প্রকারভেদ—
স্বাভাবিক < ১২০ এবং < ৮০ (মিলিমিটার পারদচাপ)
প্রাক্-উচ্চ রক্তচাপ ১২০-১৩৯ অথবা ৮০-৮৯ (মিলিমিটার পারদচাপ)
উচ্চ রক্তচাপ (পর্যায়-১) ১৪০-১৫৯ অথবা ৯০-৯৯ (মিলিমিটার পারদচাপ)
উচ্চ রক্তচাপ (পর্যায়-২ )> ১৬০ অথবা > ১০০(মিলিমিটার পারদচাপ)
সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপের পর্যায় ভিন্ন হলে সর্বোচ্চ পর্যায়কেই গণনায় নিতে হবে। যেমন কারও রক্তচাপ ১৭০/ ৯৫ মিমি পারদচাপ হলে তাঁকে পর্যায়–২ হিসেবে গণনা করতে হবে এবং সেই মোতাবেক চিকিৎসা দিতে হবে। রক্তচাপ যা–ই হোক না কেন, হৃদ্পিণ্ডের অবস্থা কিংবা অন্যান্য টার্গেট অর্গানের পরিস্থিতি বুঝে নির্ধারিত সময়ের আগেও চিকিৎসা শুরু হতে পারে। বয়সভেদেও রক্তচাপের ভিন্নতা রয়েছে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।