আদালতের স্থিতাবস্থার ফলে সরকারি চাকরিতে কোটা না থাকলেও নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে কোটা সংস্কার চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ।
তারা বলছেন, আদালতের মাধ্যমে কোটা বাতিলের সরকারি পরিপত্র বৈধ হয়ে কোটা বাতিল হলেও পরবর্তীতে সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ আইনের দ্বারস্থ হলে আবারো নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে। ফলে সংসদে আইন করে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কারের সমাধান চাইছেন তারা।
কোটা পুনঃবহালের আদেশে আদালত চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিলেও তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ।
আন্দোলনরতদের পক্ষে আদালতের নির্দেশ গেলেও তারা নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ চাইছেন। তারা বলছেন, কমিশন গঠন করে কোটার হার কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে এনে এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।
আদালতের নির্দেশের পরও কেন কমিশন গঠন ও সংসদে আইনের মাধ্যমে সমাধান চাইছেন– এমন প্রশ্নে আন্দোলনকারীরা বলছেন, ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কেউ কিংবা প্রতিবন্ধী কেউ রিট করলে তখন পরিপত্র কিংবা আদালতের আদেশ বাতিল হতে পারে। তাই আদালতের আদেশে চূড়ান্ত সমাধান দেখছেন না তারা।
আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থী বলেন, গত ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধীসহ যারা সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত তাদেরকে রাখা হয়নি। তারা যদি আবার তাদের অধিকার চেয়ে আদালতে রিট করে তাহলে তো এই পরিপত্র আবার বাতিল হয়ে যাবে। আমরা কি বার বার রাস্তায় নামবো? ছাত্রদের বার বার আদালতে নিয়ে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া সেটা থেকে আমরা বের হতে চাচ্ছি। সেজন্যই আমরা বলছি, সংসদে আইন করার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান হোক।
এছাড়া কোটার যৌক্তিক সংস্কারের জন্য যে গবেষণা বা যাচাই-বাছাই প্রয়োজন তা নির্বাহী বিভাগকেই কমিশনের মাধ্যমে করতে হবে বলে দাবি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা মনে করছেন, কমিশনের সুপারিশের আলোকে আইন পাস করাই কোটা সংস্কারের একমাত্র পথ।
আন্দোলনরত অন্য আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমদের দাবি হচ্ছে, এই সমস্যার সমাধান সংসদ থেকে আসুক। সংসদ একটি আইন পাশ করবে, একটি নীতিমালা গ্রহণ করবে- সেটা যেভাবেই করুক, কমিশন গঠন করে করুক বা সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে করুক।
ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সর্ষের ভেতরেই ভুতটা থেকে গেছে ! ফলে চূড়ান্ত ফয়সালা করতে হলে সেটা নির্বাহী বিভাগকেই করতে হবে। কোর্ট কিন্তু কখনো বলবে না যে, এই জনগোষ্ঠীকে এত শতাংশ কোটা দেয়া হোক বা ওই জনগোষ্ঠীকে এত শতাংশ দেয়া হোক। এটা কোর্টের এখতিয়ার না, সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার।’
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীসহ অনগ্রসরদের জন্য সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তখন সরকারি চাকরিতে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল ৩০ শতাংশ। এছাড়া ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা ছিল। সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ।
কোটা বাতিল করে সরকারের পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর রুল দেন হাইকোর্ট। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
পরে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন চেম্বার আদালতে হয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে ৪ জুলাই। রিট আবেদনকারীপক্ষ সময় চেয়ে আরজি জানালে সেদিন আপিল বিভাগ শুনানি পিছিয়ে দেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়। এ অবস্থায় কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে গত মঙ্গলবার আবেদন করেন দুই শিক্ষার্থী।
দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনানির জন্য বুধবার (১০ জুলাই) আপিল বিভাগে ওঠে। শুনানি শেষে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। কিছু পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনাসহ এ আদেশ দেয়া হয়। এই স্থিতাবস্থা চার সপ্তাহের জন্য উল্লেখ করে আপিল বিভাগ আগামী ৭ আগস্ট পরবর্তী দিন ধার্য করেন।
তবে আদালতের আদেশ প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর নেতারা। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিকাল ৩টা থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন তারা।