অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং অর্থনীতির অস্থিরতা নিয়ে নতুন বছরটি শুরু হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা উল্লেখ করেছেন যে, অর্থপাচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন এবং লুটপাটের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটাপন্ন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, শিল্প খাতে শ্রম অসন্তোষ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নিম্ন প্রবৃদ্ধি, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলার বাজারে অস্থিরতা এমন চ্যালেঞ্জ যা নতুন বছরের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে শিল্প খাতের সংকট আরও প্রকট হওয়ায় সম্ভাবনা রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমবে, ঋণের সুদহার বাড়বে এবং বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। মূলত রাজস্ব আয়ে সমস্যাগুলো, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। বিতর্কিত মূল্যস্ফীতি হিসাবের পর সরকার পরিবর্তনের ফলে এটি গড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস ধরে ৮ শতাংশে আটকে থাকায় মানুষ কষ্টে পড়ে যাচ্ছে।
বিদায়ি বছরের মতো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নতুন বছরেও মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করবে। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক হওয়ায় বিনিয়োগ কমে গেছে, যা শিল্প খাতকে আরও বিপর্যস্ত করছে।
এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পরিকল্পনা কার্যকর হতে হবে।
অর্থনীতিবিদ এবং খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নতুন বছরের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে প্রধান প্রধান বিষয়গুলো আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
সামষ্টিক অর্থনীতি ও মুদ্রানীতি
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বর্তমানে নানা সংকটের সম্মুখীন, যেমন মূল্যস্ফীতি, ঋণ খেলাপি, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস প্রভৃতি। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকার সরবরাহ কমানোর মতো মুদ্রানীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, অন্যন্য নীতিগত পদক্ষেপ, যেমন উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের উন্নতিসাধন, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ফিসক্যাল পলিসির পর্যালোচনা, গুরুত্বপূর্ণ।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান
অনেক প্রযুক্তিবিদ যুক্তিসঙ্গতভাবে আশঙ্কা করছেন উৎপাদন খাতে সংকট আসন্নদিনে বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে। উচ্চ কর এবং ঋণের সুদহার বৃদ্ধি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সংকটে পড়ছে। নতুন বিনিয়োগ আসছে না এবং কর্মসংস্থানের গতি নিম্নমুখী হয়।
ব্যাংক খাত
ব্যাংকিং খাতেও সংকটাপন্ন অবস্থা। ব্যাংকগুলোর অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিশ্লেষকদের মতে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো অবশ্যক।
মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা
বিগত বছরের মতোই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়ে বেশিরভাগ পরিবারের অভাব-অনটন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থায় দৈনিক বেতনের মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে।
রপ্তানি
বিশেষত পোশাক খাতে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং শ্রম অসন্তোষের ফলে শিল্পখাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে এবং দেশি খাতের বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন
চলমান বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে স্থবিরতার আশংকা থেকে যাচ্ছে। আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ প্রয়োজন।
সংক্ষেপে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মানুষ, ব্যবসা এবং সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব ধরনের স্তরে মৈত্রী ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা হবে সময়ের দাবী।