বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (৮১) মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ মঙ্গলবার রাতে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সমন্বয়কারী ও গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রধান কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মামুন মোস্তাফী রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন।
এর আগে সোমবার দুপুরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শারীরিক অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায়। তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য রোববার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন ভাস্কুলার সার্জন। তিনি মূলত জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। ১৯৮২ সালর ওষুধ নীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।
১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে জন্ম গ্রহণ করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। তবে তিনি বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন তিনি।
১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। বৃটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিডিএমএ)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা। যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহত যোদ্ধা, উদ্বাস্তু ও নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নর-নারীর জরুরি চিকিৎসাসেবায় মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস ডা. এমএ মবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল- ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার।
মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতালটি গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে গড়ে তুলেন কুমিল্লায়। পরে সেটা স্থানান্তর করেন ঢাকার অদূরে সাভারে। এ ‘গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র’ নামটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দিয়েছিলেন প্রায় ৩১ একর জমি। দেশের মানুষকে কম পয়সায় চিকিৎসা দিতে কাজ শুরু করে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল।
স্বাধীন দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন গণমানুষের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে। জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসানীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, অনিশ্চিত তখনই বিবদমান পক্ষের মাঝখানে সমঝোতার সেতুর ভূমিকা নিয়েছেন। জাতীয় সংকটে নিজের দায়বোধ থেকে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলায়।
তবে স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাকশালে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলে বিএনপিতে স্বাধীনতাবিরোধী থাকায় চার পৃষ্ঠার চিঠির মাধ্যমে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে উপেক্ষা করেছিলেন এরশাদের প্রস্তাব। তার পরামর্শেই এরশাদ আমলে পোস্টার, বিলবোর্ড বাংলায় লেখা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, উপজেলাব্যবস্থা ও সফল জাতীয় ঔষুধনীতি ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি করেছিলেন।
তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মাত্র এক হাজার ২০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করতে পারেন দরিদ্র মানুষ। তার প্রতিষ্ঠিত গণবিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বামী প্রয়াত বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া।
তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদক পান ১৯৭৭ সালে পদকটি প্রবর্তনের বছর। বিকল্প নোবেল খ্যাত র্যামন ম্যাগসাই পান ১৯৮৫ সালে। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালে সুুইডিশ ইয়ুথ পিস প্রাইজ, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেনের লাইভ লাই হুড পুরস্কার, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ’ পুরস্কার লাভ করেন।